মুঘল স্থাপনা আর সম্রাটদের নামে নামকরণের জন্য সুপরিচিত মোহাম্মদপুর, যেন মুঘল সম্রাটদের আবাসভূমি। তবে সব অভিজাত আর ঐতিহ্য পেছনে ফেলে মোহাম্মদপুর এখন রাজধানীর বুকে এক সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য।
রাত নামলেই থমকে যায় মোহাম্মদপুর, আদাবর আর হাজারীবাগ। কারণ একটাই কিশোর গ্যাং আতঙ্ক। হাতে ছুরি, কোমরে চাপাতি, চোখে এক অদ্ভুত উন্মাদনা। দলবেঁধে চলে তাণ্ডব যাত্রা। যাদের প্রত্যেকরে বয়স মাত্র ১২ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে।
ভুক্তভোগী একজন বলেন, ‘দেয়ালের ভেতরে থেকে ওরা সাত-আটজন বের হয়ে আসলো। এসেই আমার ওপর চাপাতি ধরলো, বলে- যা আছে সব দিয়ে দে। কোনো কথা কবি- গলা কেটে ফেলবো। পরে আমি যা যা আছে দিয়ে দিছি। এখানে লোকজন ডাক দিছি কেউ ভয়ে যায় না আর।’
হত্যা, ধর্ষণ, মাদক বিক্রি, আর হত্যা যেন এখানের রোজকার চিত্র। আর এলাকার দখল নিয়ে চলে হত্যাযজ্ঞ। কব্জিকাটা আনোয়ার, ডন ৭১, উই ডোন্ট কেয়ার মোহাম্মদপুর কিংস- এর মতো প্রায় অর্ধশত গ্যাংয়ের দখলে পুরো অঞ্চল। এমনটাই বললেন সাবেক দুই গ্যাং লিডার।
সাবেক গ্যাং লিডারদের মধ্যে একজন বলেন, ‘ওপেনে গাঁজা, ইয়াবা বিক্রি করছে। সব চলে এখানে, সবার ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়স।’
অন্য একজন বলেন, ‘ছোট বাচ্চা যে কন্ট্রাক্ট কিলিংয়ে যায়। কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে গেছে এরা। মাদক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এরা নিজেরা নিজেরাও মারামারি লাগে।’
আরও পড়ুন:
অভিযান চলছে, গ্রেপ্তারও হচ্ছে। অপরাধী যতই শক্তিশালী হোক না কেন তাদের আটকে অভিযান চলবে বলে জানিয়েছেন র্যাব-২ এর অধিনায়ক। জানান, সুস্থ-সংস্কৃতির অভাব আর সমাজের বিবেকবানদের নীরবতাই এদের উত্থানে সমানভাবে দায়ী।
র্যাব-২ এর অধিনায়ক অ্যাডিশনাল ডিআইজি মো. খালিদুল হক হাওলাদার বলেন, ‘আমাদের কাছে অপরাধী সবসময়ই অপরাধী। সে কিশোর অপরাধী হলে তার কিশোর আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা হচ্ছে। প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি যখন অপরাধ করছে তখন তার বিরুদ্ধে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। কিশোর যে বয়স, এসময়টা সাংস্কৃতিক, বিনোদন ও শরীর চর্চা, খেলাধুলা ইভেন্টের মধ্যে যেন তারা সময়টা পার করতে পারে এ সুযোগটা করে দিতে পারলে আমার মনে হয় তাদের এ অপরাধের হারটা কমে যাবে।’
অপরাধ দমনে পুলিশের সফল অভিযানের ব্যাখ্যা দিয়ে তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার জানান, এ কিশোররা সোশ্যাল মিডিয়া নিজেদের দলের সদস্য সংখ্যা বাড়ায়। এক একটা ফেসবুক গ্রুপ যেন এক একটা গ্যাংয়ের সদর দপ্তর। যেখানে পরিকল্পনা হয় হামলার, ঠিক হয় লক্ষ্য।
তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মো. জুয়েল রানা বলেন, ‘বৃহত্তর মোহাম্মাদপুরে প্রায় ছয় হাজারের মতো আসামিকে বিভিন্ন অপরাধে আমরা আদালতে সোপর্দ করেছি। একটা গ্রুপ খুব নাম করে ফেললো আমরা তো ওদের গোষ্ঠীসহ নির্বংশ করে দিয়েছি। এখন আবার নতুন গ্রুপের নাম সামনে আসছে করছে। টিকটক, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম আরও যেগুলো আছে সবগুলোই এ অপরাধটাকে আরও উস্কে দিচ্ছে। তারা একত্রিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এটা হতে পারে যে, কিশোরদের যে একটা উন্মাদনা কাজ করে- সবাই একত্রিত হবো, কিছু একটা হবো। এদের তো পয়সা নাই পকেটে, তখন এরা করে কী- শটকাট পদ্ধতিতে যায়। অল্প টাকা ব্যবহার করে দুইটা চাপাতি কিনে ফেলে তা নিয়ে রাস্তায় নেমে যায়।’
আরও পড়ুন:
এদিকে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনে করেন, কিশোর অপরাধ একটি ভয়ানক মহামারী। যা বন্ধ করতে না পারলে ধ্বংস হবে একটি প্রজন্ম। তাই প্রশ্ন আটকের পরে সংশোধনে না দিয়ে কীভাবে সহজেই জামিনে মুক্তি পায় এসব অপরাধী।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী পারভেজ হোসেন বলেন, ‘একটা কিশোরের অপরাধ যত বড়ই হোক না কেন সর্বোচ্চ সাজা হচ্ছে ১০ বছর। খুব কষ্ট করে বলতে হচ্ছে আমাদের আইনজীবী বন্ধুরাই এ কাজটা করছেন। একটি বড় সিন্ডিকেট এদের সঙ্গে থাকে। যেহেতু সে কিশোর, একটা সহানুভূতি যে পাবে, আইনে এ সহানুভূতি দেয়া আছে। অসত্য কিছু কাগজ তৈরি করে নানাভাবে আদালতের কাছে উপস্থাপন করে আদালতকে মিসলিড করে, ভুল বুঝিয়ে তাদের আবার ফ্রি হওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। একজন কিশোর অপরাধী যখন এভাবে একটি বড় অপরাধ করার পরও এ সিন্ডিকেটের সহযোগিতা নিয়ে সে মুক্ত হয়ে যায় তখন দ্বিতীয়বার অপরাধ করতে তার আর দ্বিধা থাকে না।’
যে বয়সে থাকার কথা ছিল স্কুলের আঙ্গিনা বা খেলার মাঠে সে বয়সে তারা আজ অপরাধের স্বর্গরাজ্য গড়ে তুলেছে এ অঞ্চলগুলোতে। রাত হলেই শুরু হয় তাদের অপরাধ আর এ অঞ্চলগুলো হয়ে ওঠে অপরাধের হটস্পট। এ শহর কার হাতে নিরাপদ বা মানুষই কতটা নিরাপদ এ শহরে? শুধুই কি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা না কি দেখেও না দেখার ভান করে থাকা এ সভ্য সমাজের।





