বিডিআর বিদ্রোহ: ন্যায়বিচার ও দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র উন্মোচনের দাবি

দেশে এখন
বিশেষ প্রতিবেদন
0

১৬ বছরেও উদঘাটন হয়নি পিলখানা হত্যাকাণ্ডের স্বরূপ। এটি শুধু একটি বিদ্রোহ, নাকি বড় কোনো ষড়যন্ত্র তা নিয়ে বিতর্ক চলছেই। কিন্তু দীর্ঘ এই সময়ে সব হারিয়ে চরম ক্ষতির শিকার বহু সেনা ও বিডিআর পরিবার। বিচার ও তদন্ত প্রক্রিয়ায় ঘটেছে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর শহীদ সেনা পরিবারগুলোর দাবি, এই ঘটনার পেছনে দেশি এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র উন্মোচনের। অপরদিকে অভিযুক্ত বিডিআর পরিবারগুলোও চাইছে ন্যায়বিচার। এমন বাস্তবতায়, সরকার গঠিত স্বাধীন তদন্ত কমিশনের ভূমিকা কী হবে, কিংবা এসব উদ্যোগ বিচারে কীভাবে প্রভাব ফেলবে?

জামিনে মুক্তি পাওয়ার আগেই, জীবন থেকেই মুক্তি মিলেছে সাবেক বিডিআর হাবিলদার এনামুল হকের। ঘুনে ধরা আসবাব, ধূলি পড়া ফ্রেম আর নির্জন দাঁড়িয়ে থাকা ঘরটি সাক্ষী চার কন্যার একটি পরিবারের ক্রমে নিঃশেষ হয়ে যাবার গল্পের।

পিলখানা হত্যা মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি বিডিআর হাবিলদার এনামুল হকের ১০ বছরের সাজাভোগ শেষ হয় ছয় বছর আগে, ২০১৯ সালে। বৃষ্টিমুখর দুপুরে, যেদিন এখন টিভির প্রতিনিধি দল ঘাটাইলের মধ্যকন্যা কুলাইতলা গ্রামে তার বাড়িতে পৌঁছায়, সেদিন কারা অন্তরীণ অবস্থায় বিডিআর হাবিলদার এনামুলের মৃত্যুর ১৩ দিন অতিবাহিত হয়েছে। তার বড় মেয়ে মিনা, আমাদের বলছিলেন, ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পরে যখন গেল মাস থেকে বিডিআর সদস্যরা জামিনে মুক্তি পেতে শুরু করলেন, তখন তার বাবার মুক্তি নিয়ে কতটা আশা করেছিলেন তারা।

মিনা বলেন, 'মনে মনে ভাবতাম যত অসুস্থই থাক, আমি বাবারে নিয়ে বাড়িতে এসে পড়বো। ১০ তারিখ জামিনের ডেট ছিল। আমরা খুব আশায় ছিলাম যে ছাড়া পেলে আমি বাবারে নিয়ে বাড়িতে যাবো সুস্থ হোক বা না হোক। ১৬ বছরে এক রাত যাপন করছি বাবার লাশ নিয়ে। এর চেয়ে মর্মান্তিক আর কী হতে পারে আমাদের জীবনে। মা মারা গেছে সাত মাস আগে।'

এবং পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মতো একটি নৃশংস ঘটনা, কত দিক দিয়ে, কত পরিবারের কত দুঃখের কারণ, তার একটা উদাহরণ প্রয়াত এনামুলের পুরো পরিবারটি। ১৬ বছর আগে যখন এনামুল শেষবারের এই বাড়ি উঠোন ছাড়ছিলেন, তখন তার ছোট মেয়ে এই রাজিয়ার বয়স ছিল সাত বছর।

রাজিয়া বলেন, 'ছোট থাকতে যখন আসতো, তখন পাশে নিয়ে বসাতো। পাশে বসিয়ে খাওয়াইতো। আর যখন যে স্যারেন্ডার করলো তখন পাশে নিয়ে জড়াইয়া ধরছিল। এরপর মাও অসুস্থ ছিল। মা মারা যাওয়ার পর থেকে তো আমার জীবনযাপন একাই, একাকিত্বে গেছে। ভাবছিলাম হয়তো দিন গেলে সে আসবে। হয়তো আমি আমার শৈশবটা পাবো।'

মূলত ১৬ বছর আগে তৎকালীন বিডিআর সদর দপ্তরের অভ্যন্তরে ৫৭ সেনা অফিসারসহ ৭৪ জনকে হত্যাযজ্ঞের ঐ ঘটনায় ২৮ ফেব্রুয়ারি একইসঙ্গে দু'টি মামলা হয়। একটি হত্যা মামলা, আরেকটি বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা। দুই মামলার আসামির সংখ্যাই ৮০০- এর বেশি এবং দু'টি মামলার কার্যক্রমই বিশেষ আদালতে একইসঙ্গে শুরু হয়।

এর মধ্যে হত্যা মামলার বিচার কাজ ২০১৩ সালে শেষ হয়ে এখন আপিল বিভাগে আছে। এই মামলায় যারা সাজা পেয়েছেন, তাদের অনেকেরই সাজার মেয়াদ শেষ। কিন্তু মুক্তি পাননি। কারণ দুই মামলার আরেকটির বিচার কাজ আটকে আছে অজানা কারণে। ফলে জামিন তো দূরে থাক, যারা প্রথম মামলার সাজা শেষ করেছেন কিংবা বেকসুর খালাস পেয়েছেন তারও এতদিন জেল থেকে বের হতে পারেননি।

মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা আইন বিশেষজ্ঞ জোতির্ময় বড়ুয়ার কাছে এখন প্রতিনিধি দল প্রশ্ন করেছিল, আইনের দৃষ্টিতে এটি কেমন দৃষ্টান্ত?

জোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, 'অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, জোর-জবরদস্তি করে, শারীরিকভাবে নির্যাতন করে তাদের অনেকের কাছ থেকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেয়া হয়েছে। সেই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেয়ার পর অনেককে আবার এনকাউন্টারে হত্যা করা হয়েছে, যাদের বলা হয়েছে যে হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছে। এরকম অনেকের ঘটনা আছে। এরকম অনেকেই যারা ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত না, অনেকেরই ফাঁসির অর্ডার হয়েছে, অনেকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। এবং এত পাইকারি হারে আসলে ফাঁসির আদেশ অন্য কোনো মামলাতে বাংলাদেশের ইতিহাসে খুবই বিরল। ১০ বছর যাবৎ কিন্তু কনডেম সেলেও আছেন অনেকে। এটা তো চরম মানবাধিকারের লঙ্ঘন।'

বিশেষ করে, ভুক্তভোগী পরিবারের উদ্বেগ, ঢালাও জামিন নিয়ে। ২৫ ফেব্রুয়ারির পিলখানা হত্যাকাণ্ড থেকে বেচে ফেরা, তৎকালীন বিডিআরের ঢাকা সেক্টর কমান্ডার শহীদ কর্নেল মুজিবুল হকের সহধর্মিনী নেহেরুন ফেরদৌসী সেদিনে দুঃসহ স্মৃতির বর্ণনা করে বলছিলেন, সবাই নির্দোষ দাবি করলে, সে দিনের ঘটনায় তাহলে সেনা কর্মকর্তাদের নৃশংসভাবে হত্যা করলো কারা?

নেহেরুন ফেরদৌসী বলেন, 'কখনও সার্ব করছো? বলে, না। তো কেন মারলা? বলে, বন্দুক পাইছি তো মারতে ভালো লাগছে। এরকম কেসও তো আছে। তাদের কি শাস্তি হবে না? তো ওরা যদি এরকম লেইম এক্সকিউজ দেখিয়ে যদি ছাড়া পায় তাহলে এটা কোনো জাস্টিস হলো? সারাদেশবাসী হাসবে। এজন্য যারা মদদদাতা তাদেরও বের করতে হবে। এটা আমরা প্রথম থেকে বলে আসছি, আমরা জানতে চাই কারা ছিল, কী কারণে তাদের হত্যা করা হলো?'

ভুক্তভোগী সেনা পরিবারের সদস্যদেরও বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে নিয়ে অসন্তোষ আছে। এবং ঘটনার মূল কুশীলব কারা এবং অতীতের যে তদন্ত তা নিয়েও নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। বলা হচ্ছে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কথা। ফলে সরকার নতুন করে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কিন্তু বিচার প্রক্রিয়া এতদূর এগোনোর পর এখন নতুন তদন্তে যদি ভিন্ন ফল আসে তাহলে এর সমাধান কী হবে?

আইনজীবী ও অধিকারকর্মী জোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, 'কোনো একজন নেতৃবৃন্দের নির্দেশে এরকম ঘটনা ঘটেছে, সেরকম যদি হয়, সেক্ষেত্রেও যারা হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলেন তাদের তো দোষ আসলে মাফ হয়ে যায় না। কিন্তু তাদের দোষটাকে অ্যাসাটেইন করার সাথে সাথে তাহলে এই হুকুমদাতার দোষটাকেও তো পাশাপাশি আনতে হবে। এবং সেটা তো একই মামলার অন্তর্গত বিষয়। কিন্তু একটা ট্রায়াল তো শেষ হয়েছে, আর বিষ্ফোরক মামলার ট্রায়াল চলছে। সেক্ষেত্রে বিচারের ক্ষেত্রে বৈসাদৃশ্য তৈরি হওয়ার কিন্তু সুযোগ আছে। আমার মতে ফ্রেশ মামলা হয়ে সেটা পাশাপাশি চলাটাই শ্রেয়।'

বিশ্লেষকরা বলছেন, গণঅভ্যুত্থানের মুখে পতন হওয়া কর্তৃত্ববাদী সরকারের হস্তক্ষেপের কারণেই, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মত স্পর্শকাতর ঘটনার পেছনে আসলে কী ছিল তা নিয়ে বিতর্ক রয়ে গেছে দীর্ঘ দেড় দশক পরেও, যার কারণে চরমভাবে ভুক্তভোগী এই মামলার বাদী-বিবাদী দুই পক্ষ কিংবা পরিবারগুলো। এখন যখন, দুই পক্ষই সব ধরনের রাজনৈতিক বিবেচনার বাইরে গিয়ে ন্যায় বিচার প্রত্যাশা করছে, তখন তা কতটুকু প্রতিষ্ঠা হবে তা নির্ভর করছে, স্বাধীন কমিশন কতটা এর স্বরূপ উদঘাটন করতে পারে, তার ওপর।

এসএস