তারেক রহমান: জনআবেগের সুনামি

তারেক রহমান ও  ড. এ. এন. এম. এহসানুল হক মিলন
তারেক রহমান ও ড. এ. এন. এম. এহসানুল হক মিলন | ছবি: সংগৃহীত
0

আজ ২৫ ডিসেম্বর, বাংলাদেশ ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষণপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। দীর্ঘ ৬ হাজার ৩১৪ দিন পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, নিপীড়িত মানুষের অবিচল আস্থার প্রতীক তারেক রহমান ফিরছেন স্বদেশে। এটি কেবল একটি প্রত্যাবর্তন নয়; এটি সতেরো বছরের অপেক্ষা, বিশ্বাস, স্মৃতি ও প্রত্যাশার সম্মিলিত প্রকাশ—যা কোটি মানুষের হৃদয়ে যত্নে সঞ্চিত ছিল।

তারেক রহমান শুধু একজন রাজনৈতিক নেতা নন। তিনি বাংলাদেশের ভবিষ্যতের আশার বাতিঘর। স্বাধীনতার ঘোষক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সন্তান হিসেবে তিনি হয়ে উঠেছেন দেশের তরুণদের পথপ্রদর্শক ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের নির্ভীক নাবিক। আজ তিনি ফিরছেন সেই মাটিতে, যেখানে তার শিকড়—প্রিয় বাংলাদেশে।

স্মৃতি আমাদের টেনে নেয় ২০০৭ সালের ৮ মার্চের গভীর রাতে। রাত সাড়ে বারোটার কাছাকাছি হঠাৎ টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে ওঠে—ব্রেকিং নিউজ: ‘তারেক রহমান গ্রেপ্তার’। মুহূর্তে সবকিছু স্তব্ধ হয়ে যায়। বিশ্বাস করা কঠিন ছিল। শরীর অবশ, ভাষা হারিয়ে যায়। স্ত্রী নাজমুন নাহার বেবি কিংবা কন্যা তানজীদা, কাউকেই ডাকার শক্তি ছিল না। নির্মম বাস্তবতা আকস্মিক আঘাতে সবকিছু থামিয়ে দিয়েছিল।

জাতীয়তাবাদী পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তানকে কোনো মামলা, অভিযোগ বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই অবৈধভাবে আটক করা হয়—ন্যূনতম আইনি প্রক্রিয়াকেও উপেক্ষা করে। ১/১১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে তাকে রিমান্ডে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন করা হয়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অসংখ্য মিথ্যা মামলায় তাকে জর্জরিত করা হয়। শুধু তারেক রহমান নন, বেগম খালেদা জিয়া ও আরাফাত রহমান কোকোও ভুয়া মামলায় কারাবন্দি হন। রাজনীতির বাইরে থাকা কোমল হৃদয়ের কোকো প্রবাসে থেকেই ২৪ জানুয়ারি ২০১৫-তে অকালে চলে যান; একটি ক্ষত রেখে, যা কখনোই পুরোপুরি সারে না।

আরও পড়ুন:

২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর জামিন পাওয়ার পর চিকিৎসার উদ্দেশে ১১ সেপ্টেম্বর তারেক রহমান লন্ডনে যান। সেখান থেকেই শুরু হয় দীর্ঘ ও অনিশ্চিত নির্বাসন। কিন্তু দূরত্ব তাকে দেশ, মানুষ কিংবা রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। একটি সাধারণ চেয়ার, একটি টেবিল আর একটি ক্যামেরাকে অবলম্বন করে তিনি প্রায় সতেরো বছর প্রবাসে থেকেও বিএনপিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮-তে বেগম খালেদা জিয়া কারাবন্দি হলে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন। দমন-পীড়ন, গ্রেপ্তার, মামলা, হুমকি ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের এই দীর্ঘ সময়ে তিনি কেবল দলটিকে টিকিয়ে রাখেননি—ঐক্যবদ্ধ, সংগঠিত ও দৃঢ় রেখেছেন। এমন চাপের মধ্যে একটি বড় রাজনৈতিক দলকে ধরে রাখা তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, ধৈর্য, দূরদর্শিতা ও নেতৃত্বের প্রমাণ।

আজকের এই প্রত্যাবর্তন অবধারিতভাবে ফিরিয়ে আনে আরেক স্মৃতি—২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার। সকাল ১১টা ৪০ মিনিটে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় স্থাপিত সাব-জেল থেকে মুক্তি পান বেগম খালেদা জিয়া। নেতাকর্মীরা তখন প্রতিটি সেকেন্ড গুনছিলেন। অটল বিশ্বাস ছিল, মুক্তি পেয়ে তিনি প্রথমে স্বামীর কবর জিয়ার মাজারে যাবেন, তারপর গুরুতর অসুস্থ ছেলে পিনুকে দেখতে পিজি হাসপাতালে ছুটবেন।

ঠিক তাই-ই ঘটেছিল। স্লোগান আর ভালোবাসার জোয়ারে তিনি জিয়ার মাজারের দিকে রওনা হন। পাঁচ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে লেগে যায় প্রায় চল্লিশ মিনিট—মানুষের ঢলে। মাজারে দাঁড়িয়ে তিনি দু’হাত তুলে দোয়া করেন, অশ্রুসিক্ত চোখে প্রিয় স্বামীর জন্য শান্তি ও ক্ষমা কামনা করেন।

এরপর পিজি হাসপাতালের পথে, রাস্তা যেন আবেগে ভেঙে পড়ে। কেবিন ৪৩২-এ ঢুকে মা বসেন অসুস্থ ছেলের পাশে, বুকে জড়িয়ে ধরেন, কপালে হাত রেখে নীরবে কাঁদেন। এমন মুহূর্তে সন্তান ছেড়ে যাওয়া কোনো মায়ের জন্য সহজ নয়। তবু তিনি গেলেন—ভালোবাসা কম ছিল বলে নয়, দায়িত্ব ছিল অপরিসীম। সন্তানের ভার আল্লাহর হাতে সপে দিয়ে তিনি ব্যক্তিগত বেদনার ঊর্ধ্বে উঠে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বকে বেছে নিলেন। সেই মায়ের উত্তরাধিকার বহন করেন তারেক রহমান।

বছরের পর বছর ধরে তার বিরুদ্ধে ৭৫টি মামলা দায়ের করা হয়—খুন থেকে দুর্নীতি, মানহানি পর্যন্ত। এর মধ্যে ৬৫টিই মানহানির মামলা। বিশেষ ক্ষমতা আইন, আইসিটি আইন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন—সবই প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু দেশে-বিদেশে বিস্তৃত তদন্তেও একটি বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। শেষ পর্যন্ত তিনি সব মামলায় খালাস পান।

২০০৭ সালে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে এক আলাপে তারেক রহমান বলেছিলেন, ‘আমি রাজনীতি করি দেশের জন্য। এর জন্য জেলে যেতে হলে যাব। আমি জিয়াউর রহমানের ছেলে। বিএনপি ও জাতীয়তাবাদী শক্তির বিরুদ্ধে যারা, তারাই এসব অপপ্রচার চালায়। আমি চ্যালেঞ্জ করি, কেউ প্রমাণ করুক, আমি কখনো কোনো মন্ত্রী বা সচিবকে প্রভাবিত করতে ফোন করেছি।’

আরও পড়ুন:

তিনি আরও বলেছিলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে, কিন্তু বিএনপিবিরোধী নির্বাচিত অপপ্রচার শান্তিপ্রিয় মানুষ কখনোই মেনে নেবে না। জেলে যেতে প্রস্তুতি আছে কি না—এ প্রশ্নে তার উত্তর ছিল দৃঢ়, ‘রাজনীতি আমাকে জেলে নিলে কোনো আক্ষেপ নেই। কিন্তু অন্যায় হলে এ দেশের মানুষই হবে শেষ বিচারক।’

শৈশব থেকেই ইতিহাসের কঠিন বাস্তবতায় বড় হয়েছেন তারেক রহমান। ১৯৭১ সালে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তিনি মা ও ভাইসহ পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দি হন। মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, বাবার বিরুদ্ধে একের পর এক সামরিক অভ্যুত্থান দেখেছেন, অল্প বয়সেই পিতৃহারা হয়েছেন। মায়ের অবিরাম সংগ্রাম ও পারিবারিক ত্যাগ তাকে গড়ে তুলেছে দৃঢ়চেতা, নীতিনিষ্ঠ ও আপসহীন এক নেতায়—যার ব্যক্তিত্বে ইতিহাসের ভার ও ত্যাগের শৃঙ্খলা।

এই প্রত্যাবর্তন তাই কেবল একজন নেতার ঘরে ফেরা নয়। এটি সতেরো বছর পর শিকড়ে ফেরার আবেগ—যে দেশে তার শৈশব, সংগ্রাম, স্বপ্ন এবং পিতা ও ভ্রাতার কবর। দমন-পীড়ন, অনিশ্চয়তা ও দূরত্ব সত্ত্বেও তিনি বিশ্বাস হারাননি। প্রবাসে থেকেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন অবিচল দৃঢ়তায়—সংগ্রাম, ত্যাগ ও আপসহীন অঙ্গীকারের জীবন্ত প্রতীক হয়ে।

এই ফেরা ব্যক্তিগত নয়, প্রজন্মগত। তার নাম উচ্চারিত হলে কণ্ঠ কাঁপে, চোখ ভিজে ওঠে আশায়। এটি একজন মানুষের প্রত্যাবর্তন নয়; এটি মর্যাদা, আকাঙ্ক্ষা ও সম্মিলিত বিশ্বাসের ফিরে আসা একটি মুহূর্ত, যা ব্যক্তি ছাপিয়ে জনআবেগের সুনামি হয়ে ওঠে।

লেখক: ড. এ. এন. এম. এহসানুল হক মিলন; সাবেক প্রতিমন্ত্রী, শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

এনএইচ