সংস্কৃতি ও বিনোদন
দেশে এখন
0

তারুণ্যের প্রতিবাদের ভাষা যখন কাওয়ালি

আধ্যাত্মিকতার জগতে বুঁদ হন কাওয়ালি ভক্তরা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কাওয়ালি আসরে হাজার হাজার তরুণের কণ্ঠে তাই এক সুর। তবে এই কাওয়ালি নতুন কিছু নয় বরং পুরান ঢাকার অলিগলিতে ২০০ বছর ধরে বসে এ গানের জলসা। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাওয়ালি বর্তমানে হয়ে উঠেছে তারুণ্যের প্রতিবাদের অন্যতম ভাষা।

আলো-আঁধারি পরিবেশে মৃদু আলোয় ভেসে আসে এক সুর। সেই সুরে আছে মাদকতা। এ যেন এক আধ্যাত্মিকতার জগতে প্রবেশের পথ।

হারমোনিয়াম, তবলা কিংবা দফের মিশ্রণে তৈরি হয় সুর ও তালের মিতালি। সেই সুরের টানে দুলে ওঠে মাথা। সেই ছন্দের মায়ায় ৭০০ বছর ধরে বুদ হয়েছে কত মানুষ, সে হিসেব নেই কোনো খাতায়। এ সেই সুর, কাওয়ালি। এ এক স্রষ্টাকে ভালোবাসার মাধ্যম।

কাওয়ালি শিল্পী মোহাম্মাদ আল-আমীন বলেন, 'কাওয়ালি আল্লাহর একত্ববাদের স্বীকার করে। এটাই হচ্ছে কাওয়ালির মূল অ্যাসেন্স। আর স্বাভাবিকভাবে আমরা যে কাওয়ালি শুনে থাকি সেগুলো শিরক প্রমোট করে। নেগেটিভিটি প্রমোট করে। এগুলোর সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।’

গবেষক, কবি, লেখক ও কবি ফরহাদ মজহার বলেন, 'এই যে আল্লাহর সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হয়ে আমরা আমাদের সীমিত জীবনকে একটা অসীমের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার যে সাধনা এটাই কাওয়ালি। এটা সুরের মধ্যে যেমন আছে, অধিকাংশ কাওয়ালি লিরিক্সের মধ্যে এটা পাওয়া যায়। এজন্য এটা অত্যন্ত গভীর এবং আমাদের আবেদন সৃষ্টি করে।'

এ সংগীতে মিশে আছে অপূর্ব খোদা প্রেম, রাসুলের দিদার আকাঙ্ক্ষা, মানবাত্মার রহস্য। এ গানে আছে শৃঙ্খলার মাধুর্য।

কাওয়ালি সংগীত উপভোগ করছে শ্রোতারা। ছবি: এখন টিভি

শিল্পী হায়দার হোসেন বলেন, 'নিয়ম হলো কাওয়ালি অনুষ্ঠানে যখন বসবে, প্রথম যার বন্দনা করবে, সেটা আল্লাহর বন্দনা করতে হবে। এরপর রসূল মুহাম্মদ (সঃ) এর বন্দনা করা যাবে। এরপর মানুষের প্রেম, এই যে মানুষে মানুষে যে প্রেম আছে সেটাও গান কিন্তু কাওয়ালিতে আসে।'

দিল্লির পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী কাওয়াল নামক যাযাবর সম্প্রদায় কর্তৃক ভক্তিমূলক গানকে তাদের সাথে মিলিয়ে কাওয়ালি বলা হতো। দিল্লির সুফি সাধক আমির খসরু, তেরোশ' শতকের শেষভাগে পার্সিয়ান, আরবি, তুর্কি এবং ভারতবর্ষের ঐতিহ্যের মিশ্রণ ঘটিয়ে আজকের কাওয়ালি সঙ্গীত তৈরি করেন। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে কাওয়ালি সেশনের আনুষ্ঠানিক নাম 'মেহফিল-ই-সাম'।

ব্যান্ড কাসীদার কো-ফাউন্ডার আহমদ আতাউল্লাহ সালমান বলেন, 'সংগীতের সবচেয়ে উচ্চাঙ্গের যে ব্যাপারটা, ক্লাসিক্যাল যে মুড বলা হয়, সেটা দিয়েই কাওয়ালির সুর করা হয়। কাওয়ালির কথাগুলোও থাকে সৃষ্টিকর্তার কাছে কিছু চাওয়ার, তার সাথে সম্পর্কের কিছু মাধ্যম তৈরি করার, আধ্যাত্মিক মনের তৃপ্তি মেটানোর।'

ইতিহাস বলছে এ সাংস্কৃতিক বাংলার মানুষের। ঢাকার নবাবদের বিনোদনের অন্যতম উৎস ছিল কাওয়ালি। পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের বিভিন্ন উৎসব ও বিয়েতে এখনও রাতভর ভেসে আসে কাওয়ালির সুর।

পুরান ঢাকার একজন বলেন, 'এগুলো আমরা জন্মগতবাবে শুনে আসছি ভাই। বাপ-দারা করতেছে, আমরা এখনও শুনতেছি, শিখতেছি। করতেছি এবং ভবিষ্যতেও করবো। ইনশাআল্লাহ আমাদের বাচ্চাদেরও করাবো।

কাওয়ালি পরিবেশনা করছেন শিল্পীরা। ছবি: এখন টিভি

২০২২ সালে কাওয়ালি আসরে হামলা করা হয়। অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা আসে এ সংগীতের উপর। আখ্যা দেয়া হয় অপসংস্কৃতির। আসলেই কি তাই?

লেখক ফরহাদ মজহার বলেন, 'যা কিছু ইসলামের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে, এটাকে হেয় করা, সবসময় বাদ দেয়া এবং একটা বিশেষ ধরনের সংস্কৃতিতে অতিরিক্ত প্রাধান্য দেয়া। যেমন রবীন্দ্র সংগীত, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, বাঙালি সংস্কৃতির অংশ। এটাকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়ার ফলে বাংলাদেশে এ ফ্যাসিস্ট শক্তি বিরোধী একটা প্রতিবাদ হিসেবে কাওয়ালি গাওয়া হচ্ছে।'

সংস্কৃতি আক্রান্ত হলে তার শক্তি বরং আরও বেড়ে যায়। তাই কাওয়ালিকে তরুণদের মন পিঞ্জিরায় সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠেছে। তরুণরাও লিখছে কাওয়ালি। দেশের সর্বত্র আয়োজন হচ্ছে কাওয়ালি আসর।

ব্যান্ড কাসীদার ফাউন্ডার মো. শাহিনুর রহমান বলেন, 'ভারত বা পাকিস্তানে অনেক সময় চার্চে কাওয়ালীর জলসার আয়োজন করা হয়। সেখানে সুফী ড্যান্স হয় সাথে কাওয়ালি চলে। এখানে সবার একটা সম্মিলন ঘটে। যেখানে দল-মত নির্বিশেষে সবাই অংশগ্রহণ করে।'

এসএস