ধানমন্ডির বাসিন্দা তৌফিকুল ইসলাম শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে দেখছেন ফুটবল খেলা। গরমের অস্বস্তি থেকে বাঁচতে বছর দু'য়েক আগে এসি কিনেছিলেন। কত ডিগ্রি তাপমাত্রায় আরামবোধ করেন তিনি?
তৌফিকুল ইসলাম বলেন, '২২ থেকে ২৩ আমরা ব্যবহার করে থাকি। যখন আমাদের রুম দ্রুত ঠান্ডা করার প্রয়োজন হয়, তখন আমরা ২০ এ ব্যবহার করি।'
মানিকগঞ্জের স্বল্প সিংজুরি গ্রামের লাভলী বেগমের নিত্যদিনের কাজ, ছয় জনের সংসারে প্রতিদিন দু'বেলা নিয়ম করে বসতে হয় জ্বলন্ত উনুনের পাশে। আগুনের তাপে ক্লান্ত গৃহবধুর শান্তি মেলে কীভাবে?
লাভলি বেগম বলেন, 'কাজ কর্ম করার পর যে একটু রেস্ট নেবো সেই সুযোগ নেই। আমাদের এদিকে বিদ্যুতের ঘাটতি আছে।'
জমিতে গভীর মনোযোগ দেন কৃষক রিপন মিয়ার। বর্ষা মৌসুম হলেও বৃষ্টির অভাবে সেচ দিতে হচ্ছে বৈদ্যুতিক পাম্পের সাহায্যে। লোডশেডিংয়ের কারণে সূর্যের তাপের সমান্তরালে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রান্তিক এই কৃষকের চিন্তা।
রিপন মিয়া বলেন, 'কারেন্ট তো থাকেই না। প্রতিঘণ্টায় ১৫ থেকে ২০ মিনিট কারেন্ট থাকে। গেলে আর আসে না। বারবার এসে মোটরের সুইচ দেই। কিন্তু কারেন্ট না থাকায় জমিতে সেচ দিতে পারি না।'
একদিকে বিদ্যুৎ এর অভাবে কৃষক রিপন মিয়ার কপালে চিন্তার মেঘ ও গৃহবধুর চোখেমুখে হতাশার ছাপ। অন্যদিকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রন যন্ত্রের ব্যবহার। দৃশ্যগুলো একইসময়ের হলেও ভিন্নতার কারন কী? গবেষণা বলছে, বর্তমানে দেশে প্রায় ১৯ লাখ রেসিডেনশিয়াল এসি চলমান আছে। কয়েকবছর আগেও এসি মানুষের কাছে বিলাসী পণ্য ছিল। তবে এখন সেটি নিত্যপণ্যের তালিকায় চলে এসেছে। দিন দিন এসি ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ার ফলে চাপ বাড়ছে জাতীয় গ্রিডে, তৈরি হচ্ছে বিদ্যুৎ ঘাটতি। জাতীয় গ্রিডে বিদ্যু ঘাটতি তৈরি করে বলে মানুষ কী এসি ব্যবহার করবে না? নিশ্চয়ই করবে, প্রশ্ন হলো কত ডিগ্রি তাপমাত্রায় তা ব্যবহার করবে?
তৌফিকুল ইসলাম ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় আরামবোধ করলেও অন্যদের আরামবোধ হয় কত ডিগ্রি তাপমাত্রায়?
স্থানীয় একজন বলেন, 'এসিটা আমি ১৯, ২০ বা সর্বোচ্চ ২২ এর মধ্যেই চালাই সবসময়।'
একদিকে এসি ব্যবহার করে একশ্রেণির মানুষ প্রয়োজন অনুযায়ী নিজেকে শীতল রাখছেন, অন্যদিকে বিদ্যুতের অভাবে ব্যাহত হচ্ছে কৃষির সেচ, বাড়ছে জনপদে বিদ্যুৎ বঞ্চিতের সংখ্যা।
কয়েকবছর ধরে সারাদেশে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে এসি ব্যবহারকারীর সংখ্যা। যা চাপ বাড়াচ্ছে বিদ্যুতের যোগানে। ২২ ডিগ্রি তাপমাত্রায় দেড় টনের এসিগুলো এক ঘণ্টা ব্যবহার করলে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ হয় ২৬ ডিগ্রি তাপমাত্রায় চালালে তা ৫০ শতাংশ কমে আসে।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্টের একটি গবেষণা বলছে, আবাসিক ও অফিস আদালতে বর্তমানে চালু থাকা ১৯ লাখ এসি ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এক ঘন্টা চললে এক হাজার ৮২০ থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হয়। ২৬ ডিগ্রি তাপমাত্রায় চললে বিদ্যুৎ খরচের পরিমাণ দাঁড়ায় এক হাজার ১৫০ থেকে এক হাজার ২২০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ চার ডিগ্রি ব্যবধানে বিদ্যুৎ সঞ্চয় হয় ৬৭০ থেকে ৭৮০ মেগাওয়াট। যা দিয়ে প্রায় তিন লাখ ৩৫ হাজার থেকে চার লাখ গ্রামীণ পরিবার তাদের দৈনন্দিন বিদ্যুতের প্রয়োজন মেটাতে পারে। জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুতের চাপ কমাতে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় এসি ব্যবহারের পাশাপাশি ইনভার্টার এসির দাম কমানো ও গ্রাহক পর্যায়ে সরকারের বিদ্যুৎ সরবরাহ নীতি পরিবর্তনের পরামর্শ দেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞেরা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, 'যদি সবাইকে সমানভাবে লোডশেডিং করতে চায় সরকার তাইলে চাইলেই সবাইকে লোডশেডিং করতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে শহরের লোডশেডিং কম করা হচ্ছে। কারণ সাফারিং শহরে বেশি হলে সেটা সরকারের জন্য বেশি চাপ সৃষ্টি করে।'
বাসাবাড়িতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের বেশি ব্যবহার গ্রাহক পর্যায়ে বৈষম্য যেমন বাড়াচ্ছে তেমনি তৈরি করছে দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক ক্ষতি। বিশ্বব্যাংকের ২০১৮ সালের একটি জরিপ বলছে, বাংলাদেশে তাপমাত্রা কমানোর খরচ ২০৫০ সালের মধ্যে জিডিপি'র প্রায় ৬.৭ শতাংশ হবে।
ক্যাপসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, 'হিটওয়েভ থেকে এই নগরকে বাঁচানোর যে প্রচেষ্টা আছে, সেখানেও কিন্তু এই শহরের ওভারঅল যে ম্যানেজমেন্টাল কস্ট সেটি বৃদ্ধি পাচ্ছে।'
অতিরিক্ত শীতাতপ নিয়ন্ত্রন যন্ত্রের ব্যবহারের জন্য দায়ী করা হচ্ছে অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণকে। বিদ্যুতের উপর চাপ কমাতে ও গ্রাহক পর্যায়ে সাম্যতা তৈরিতে স্থায়ী নগর পরিকল্পনার সাথে জনস্বাস্থ্যকর ইমারত বিধিমালা, বিল্ডিং কোডগুলো প্রণয়নের কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
আইপিডি'র নির্বাহী পরিচালক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, 'গরম বাড়ছে, গরম থেকে বাঁচতে আমরা বাধ্য হয়ে এসি কিনছি। তখন এসির তাপটা আবার বাইরে চলে যাচ্ছে। উচ্চ ভবনের জন্য রুলস ও রেগুলেশন সারা পৃথিবীতেই আমরা দেখি দু'টি উচ্চতর ভবনের মধ্যে পর্যপ্ত ফাঁকা থাকে, যেন আমাদের পর্যাপ্ত পরিমাণ আলো-বাতাস থাকে। এত আমাদের স্বাস্থ্য ভালো থাকলে বিদ্যুতের ওপর চাপও কমবে।'
দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৩০ হাজার ৭৩৮ মেগাওয়াট। চলতি বছর সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে এপ্রিলে, ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট। কিন্তু তারপরও গ্রাম-গঞ্জে কিংবা প্রান্তিক জনপদে কেন লোডশেডিংয়ের ভোগান্তি পোহাতে হয়, মেলে না সে প্রশ্নের উত্তর।