দেশে এখন
0

ফাস্টফুডে পাল্টে গেছে বাজারের চিত্র; বাড়ছে অসুখ ও চিকিৎসা ব্যয়

চটজলদি বা ঝটপট খাবার সবাই চেনে ফাস্টফুড নামে। এর প্রভাবেই পাল্টে গেছে গ্রামের বাজার কিংবা শহুরে আড্ডার রসনা ঐতিহ্য। ঠিক তার ছায়া হয়ে দাঁড়িয়েছে স্থুলতা, ক্ষুধামন্দা, কর্মে অবসাদ। বাড়ছে অসুখের খরচ। তবে এসব স্বাস্থ্য ঝুঁকি মাথায় নিয়েও ফাস্টফুড ঘিরে দেশে কর্মসংস্থান হয়েছে ত্রিশ লাখের বেশি। যদিও রেস্তোরাঁয় খাবারের গ্রেডিং চালুর বাস্তবায়ন চলছে ধীরগতিতে।

ধানী জমি, গরু বাছুরের চারণভূমি পেরিয়ে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার লোকালয়ে দৃশ্য মিলে যায় শহুরের সাথে। গ্রামীণ জনপদে রাস্তার দু'পাশে গড়ে ওঠা দোকান-রেস্তোরাঁয় বিকেলের আয়োজনে বার্গার, স্যান্ডইউচ, পাউরুটির ভেতর মাংসের কিমা দিয়ে চিকেন টোস্ট তৈরি করা হয়। সব বয়সি মানুষ এসবের ক্রেতা। এর মাঝে ঘানি ভাঙা সরিষায় মুড়িমাখা, চিড়া, নিমকি, বাতাসা গ্রাম ছাড়া হলো নিরবেই৷

এ গ্রাম থেকে ১৬ কিলো কেন্দ্রে চট্টগ্রাম মূল নগরীতে ফাস্টফুডের জাল বিস্তৃত হয়েছে তিন দশক ধরে৷ এখন তা পরিণত হয়েছে অভ্যাসে৷ একসময় নগরীর অভিজাত দুই একটি রেস্টুরেন্টে মিলতো এ খাবার, এখন সড়কের পাশ, বিনোদন স্পট, গলির মুখ কিংবা বাসার নিচেও আছে ফাস্ট ফুডের দোকান। ষোল শহরের বিপ্লব উদ্যান্যের মতো নগরীর বিভিন্ন পয়েন্ট এখন শুধুই ফাস্টফুডের দখলে আছে।

চট্টগ্রাম শহরে বর্তমানে অভিযাত ফাস্টফুডের সংখ্যা ১৫০টির কাছাকাছি। এর বাইরে মার্কেট কেন্দ্রিক ফুডকোর্ট আর স্ট্রিটফুড মিলিয়ে আরও ৫০০টির মতো দোকান রয়েছে। এসব দোকানে দৈনিক গড়ে ২০ হাজার টাকা বেঁচাকেনা হয়। সবশেষে মাস শেষে চট্টগ্রামে প্রায় ৪০ কোটি টাকার ফাস্টফুডের বাজার রয়েছে।

একজন বিক্রেতা বলেন, 'স্ট্রিটফুড, থাইফুড, এরাবিয়ান ফুড আছে, মানে হচ্ছে এখানে সবধরনের ফুড পাওয়া যায়।'

একজন ক্রেতা ফাস্টফুডের খাবার কিনতে গিয়েছেন। ছবি: এখন টিভি

একজন ক্রেতা বলেন, 'স্ট্রিটফুডগুলোর হাইজিনের ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন থাকে। এই খাবারের হেলথ ইস্যু থাকবে, তবে সেটা যদি লিমিট অনুযায়ী খাওয়া হয়, তাহলে এটা শরীরের জন্য ক্ষতিকর নয়।'

একসময় বাংলাদেশের বেকারি পণ্যের জয়কার ওঠে নোয়াখালীর মাইজদী থেকে। জেলার এ ঐতিহ্য এখনও কিছুটা টিকে থাকলেও তার চোখে চোখ রেখে জিতে যাচ্ছে ফাস্টফুড৷ জেলার ৯ উপজেলায় ছোট বড় মিলিয়ে আছে ২০০ এরও বেশি ফাস্টফুডের দোকান। যেখানে সকাল থেকে মধ্যরাতঅবদি প্রতিদিন বিক্রি ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা৷ এক দশক আগেও এখানে ১৫ থেকে ২০টি দোকান ছিল বলে জানান স্থানীয়রা

একজন স্থানীয় বলেন, 'এই খাবারগুলো এমন যে একবার খেলে প্রতিনিয়তই খেতে মন চায়। তাই এগুলো খাওয়া হয়। তবে আগে কিন্তু এতো দোকান ছিল না। এই ১০ বছর আগেও এখানে সর্বোচ্চ হলে ২০টি দোকান ছিল।'

ফাস্টফুডের যে জাদু পুরো দেশকে আচ্ছন্ন করেছে তার বাজিকর হলো ঢাকা। এখানে প্রথম ফাস্টফুড এসেছিল সুইচ বেকারির বেকারির কাঁচঘরে। অলিম্পিয়ার হ্যাম বার্গার, ফ্রেন্স ও সুইচ বেকারির হাত ধরে এসেছিল বার্গার-হটডগ। ৪ দশক ধরে সুইচ বেকারি ব্যাবসা করে আসছে সুনামের সঙ্গে। সময়ের সাথে তাদের কাঁচঘরে তাল মিলিয়ে এসেছে নতুন নতুন ফাস্টফুড।

ফাস্টফুডের তালিকা কেবলই লম্বা হয়েছে এরপর থেকে। চারদশকে রেস্তোরার বাইরে ফাস্টফুড ডালপালা মেলেছে ফুটপাত, পার্ক, বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে। যাতে প্রলুব্ধ হয়ে ভোজন রসিক ডুবেছে মোহে। নিয়মিত অভ্যাসে আপন করে নিয়েছে অসংক্রামক ব্যাধি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেলের এক গবেষণার তথ্য বলছে গ্যাস্ট্রিক, ফ্যাটি লিভার, কোলন ক্যান্সার, ডায়াবেটিসের মতো ব্যধি লাফিয়ে বাড়ছে৷

স্ট্রিটফুডের দোকান থেকে খাবার খেতে দাঁড়িয়ে আছে ভোক্তা। ছবি: এখন টিভি

দেশে মোট মৃত্যুর ৬৭ শতাংশই অসংক্রামক রোগে। বিএসএমএমইউ এর পৃথক এক গবেষণায় পাওয়া যায় ফাস্টফুডে ক্ষতিকর উপাদানের উচ্চমাত্রা।

পাশাপাশি অগ্নাশয়, পেটের জ্বালায় ঘি ঢালা ফাস্টফুডের সমান্তরালে বেড়েছে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধের বাজার। ২০২১ পর্যন্ত পাঁচ বছরে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ বিক্রি বেড়েছে ১২ শতাংশ হারে। একই প্রবৃদ্ধি থাকলে বর্তমানে দেশে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধের বাজার দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার।

ক্ষুধামন্দা, স্থুলতা, উচ্চ রক্তচাপ, অনিদ্রার মতো শারীরিক সমস্যা নিয়েও রাজধানীবাসি নিয়মিত মুখে তুলছে ফাস্টফুড। সময় স্বল্পতা, সহজলভ্যতার অজুহাতে ভুলতে বসেছেন দেশি ও সুষম খাবার।

একজন ভোক্তা বলেন, 'আমি কয়েকদিন আগেই ভারত থেকে ডাক্তার দেখিয়ে আসছি। এখন একটু সাবধানে থাকছি। কারণ আবার এই গ্যাস্ট্রিক যেন কোনো সমস্যা না করে। আগে এই ফাস্টফুডের খাবার দিয়েই নাস্তা করতাম। আবার দেখা যেত রাতের খাবার বাইরে থেকেই খেয়ে যেতাম, সেজন্য বাসায় খেতাম না।'

গড়ে ওঠা বিরুপ খাদ্যভ্যাসের কারণে বছর বছর চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে। গত দুই দশকে মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় বেড়েছে ৭ গুণ৷ যার ৬৪ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে শুধু ওষুধে। সরকার এ খাতে বরাদ্দ বাড়ালেও দেশের মোট স্বাস্থ্য ব্যায়ের দুই-তৃতীয়াংশ ব্যয় হয় ব্যক্তির নিজ খরচে। চিকিৎসা বলছেন ব্যক্তি পর্যায়ে চিকিৎসা ও ওষুধ খরচ বৃদ্ধির কারণ খাদ্যভ্যাসের পরিবর্তন। ফাস্টফুডে আসক্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু ও তরুণরা

চট্টগ্রাম এভারকেয়ার হাসপাতালের কনসাল্টেন্ট বলেন, 'আমরা এরকম প্রচুর বাচ্চা পাই যাদের ঘনঘন বমি ডায়রিয়া হয় এবং এর জন্য ওজন বাড়ছে না ঠিকভাবে। এই ফাস্টফুডের প্রধান উপকরণ কার্বোহাইড্রেট। এতে শর্করা পাচ্ছে আর এর সাথে ফ্যাট কম্পোনেন্ট বেশি থাকে। এটা যখনই নির্দিষ্ট মাত্রার ওপর যাবে তখনই শরীরের ক্ষতি করতে থাকবে।'

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের গ্যাট্রোএন্টেরোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, 'এই ফাস্টফুডের কারণে নানা ধরনের রোগ হতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ফ্যাটি লিভার। এতে লিভারে চর্বি জমে যায়। এছাড়াও আরও কিছু অসুখ আছে যেগুলো ফাস্টফুড থেকে খুব দ্রুত হয়। এগুলো থেকে লিভার ক্যান্সার হয়ে যেতে পারে।'

তবে এসব স্বাস্থ্য ঝুঁকি মাথায় নিয়েও ফাস্টফুডকে কেন্দ্র করে যে রেস্টুরেন্ট ব্যবসার প্রসার ঘটেছে তাতে প্রায় ত্রিশ লাখ মানুষের রুটি-রুজির ব্যবস্থা হয়েছে বলে দাবি করছে রেস্টুরেন্ট ওনার্স এসোসিয়েশন৷ ২০১০ এর পর এ সেবা খাতে ১২ লাখ নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে। বিবিএস এর সবশেষ হালনাগাদ বলছে ১১ বছর ব্যবধানে দেশে রেস্টুরেন্ট সংখ্যা ২ লাখ ৭৫ হাজার থেকে ৪ লাখ ৩৬ হাজারে পৌঁছেছে। এ খাতে বছরে বিক্রি ৩৮ হাজার কোটি টাকা যা জিডিপির ১ শতাংশের কিছু বেশি৷

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে রেস্তোরাঁয় খাবারে গ্রেডিং চালু করলেও তা সীমাবদ্ধ ভালো রেস্তোরাঁর মধ্যেই৷

বাজারভিত্তিক অর্থনীতিতে চাহিদা অনুযায়ী যোগান বাড়িয়ে মুনাফা করার প্রবণতা রয়েছে৷ যার ফলে শুধু ভোক্তা নয় উদ্যোক্তার কাছেও ফাস্টফুড গত দশ বছরে বিনিয়োগের শীর্ষ পছন্দে উঠে এসেছে৷ তবে নতুন এ খাদ্যাভ্যাস কর্মদক্ষতা, স্বাস্থ্য বা অর্থের উপর যা চাপ তৈরি করেছে তা নিয়ন্ত্রণ কার দায়? ভোক্তা, উৎপাদক না রাষ্ট্রের?

বাংলাদেশ রেস্তোঁরা মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, 'পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের মাস্টার শেফ নেই বললেই চলে। আমাদের ট্রেডিশনাল খাবারগুলো এখন প্রোমোট করার সময় হয়ে এসেছে। এতে করে আমাদের দেশে ফাস্টফুড থেকে কিছুটা মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে।'

গ্রাম থেকে মহানগর এখন টেলিভিশন যখন ছুটে বেড়িয়েছে ফাস্টফুডের বিস্তার চিহ্নিত করতে৷ তখন ক্যামেরার সামনে ও পেছনে ধরা পরে নানান চিত্র৷ রয়েছে অস্বাস্থ্যকর উপকরণ, আমদানি ব্যয়, লাভ-ক্ষতির হিসেব বা তথ্যের নানা অপ্রতুলতা।

এসএস