স্বাস্থ্য
দেশে এখন
0

সরকারি মেডিকেলে আয়ুর্বেদ-ইউনানী বিভাগ চালু হলেও প্রসারে ঘাটতি

এখনো ফুটপাত আর মানতাশার দোকানে আটকে আছে গাছের লতা-পাতা, আকড়-বাকড়ে ভর করে গড়ে ওঠা প্রায় ৫ হাজার বছরের পুরনো ভেষজ চিকিৎসা। মানুষের আস্থা ফেরাতে সরকারি মেডিকেল-হাসপাতালে আয়ুর্বেদ-ইউনানী বিভাগ চালু করলেও জানে না সাধারণ মানুষ। তারপরেও ধীর পায়ে এগিয়ে চলা ভেষজ ওষুধের বাজার থেকে বছরে সরকারের রাজস্ব আয়ের পরিমাণ প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা।

আমাশয় কিংবা অকালে চুল পাকা রোধে বহেড়ার ব্যবহার নতুন নয়। দেহের রক্ত পরিষ্কার, শক্তি বৃদ্ধি, রক্তচাপ ও অন্ত্রের খিঁচুনি কমাতে এমনকি কোষ্ঠকাঠিন্য, স্নায়ুবিক দুর্বলতাসহ হরিতকির ব্যবহার বেশ পুরনো।

এলোপ্যাথিক আর হোমিও চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কারের আগে প্রাচীনকালে রোগ সারাতে মানতাশার দোকানে সাজিয়ে রাখা শতশত ভেষজ গুণসমৃদ্ধ গাছগাছালি ছিল মানুষের প্রধান ভরসা। সময়ের পরিক্রমায় বাড়ি থেকে হারিয়ে গেছে ওষুধ গুড়ো করার খল-নুড়ি। কমেছে অভিজ্ঞ কবিরাজও।

নাচ-গানের লোভ দেখিয়ে হাটুরেদের জড়ো করার এই কৌশল বেশ পুরনো। একটা পর্যায়ে কথার ফুলঝুড়িতে বধ করে গ্রামের সহজ-সরল মানুষ হয় হকারের শিকার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা ভেষজ চিকিৎসার নামে সর্ব রোগের মহাঔষধ বলে হাতে তুলে দেয়া হয় অনুমোদনহীন, অখ্যাত-কুখ্যাত কোম্পানির ভুয়া ওষুধ।

কোনো ধরণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত ভেষজ চিকিৎসা ফেরাতে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। দেশে ২০০ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ৫৮টি জেলা হাসপাতাল ও ১২টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিরায়ত চিকিৎসা সেবা ও প্রয়োজনীয় ওষুধ বিনামূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে।

বাস্তবে সেই উদ্যোগের প্রতিফলন দেখতে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যায় এখন টেলিভিশন। বিভিন্ন রোগ-ব্যাধী নিয়ে এলোপ্যাথিক চিকিৎসকদের কক্ষের সামনে শত শত রোগীর ভিড়। আয়ুর্বেদ ও ইউনানী মেডিকেল অফিসারের জন্য বরাদ্দ দেয়া একমাত্র কক্ষের সামনে রোগী নেই বললেই চলে।

রোগীশূন্য আয়ুর্বেদ ও ইউনানী মেডিকেল অফিসারের কক্ষ। ছবি: এখন টিভি

আয়ুর্বেদ এবং ইউনানী চিকিৎসার প্রসারে সরকার হাসপাতাল এবং মেডিকেল কলেজগুলোতে আলাদা বিভাগ চালু করলেও এসব চিকিৎসার প্রসারে তেমন কোনো সচেতনতার উদ্যোগ নেই। এই যেমন শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আয়ুর্বেদ, ইউনানী সংক্রান্ত কোনো বিলবোর্ড, লিফলেট কিংবা প্রচার-প্রচারণা নেই। যার কারণে মানুষ এসব চিকিৎসা নিয়ে এখনো অজানাই থেকে যাচ্ছে।

চিকিৎসা নিতে আসা একজন বলেন, 'এই মেডিকেলে যে আয়ুর্বেদী এবং ইউনানী একটি বিভাগ আছে এবং সেখানে চিকিৎসা দেওয়া হয়, সেটা আমরা অনেকেই জানি না।'

আড়াইশ' শয্যাবিশিষ্ট মোহাম্মদ আলী হাসপাতাল। এখানেও রোগীর খরা দেখা গেলো বর্হিঃবিভাগে ইউনানী মেডিকেল অফিসার ডা. আসাদুর রহমানের কক্ষে। জানা গেলে, রোগীদের বিনামূল্যে সরবরাহের জন্য সরকারিভাবে বরাদ্দকৃত ৫ লাখ টাকার ওষুধের সবটুকু শেষ হয়েছে গত বছরের নভেম্বরে। এরপর প্রায় সাত মাস ধরে ওষুধ সরবরাহ বন্ধ।

ডা. মো. আসাদুর রহমান বলেন, 'একজন মেডিকেল অফিসারের জন্য যদি বছরে ২০-২৫ লাখ টাকার ওষুধ বরাদ্দ করা হয়, তাহলে আমাদের এখানে প্রচুর রোগী হবে।'

শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের ইউনানী মেডিকেল অফিসার ডা. মো. মোফাজ্জল হোসেন বলেন, 'আমরা বিভিন্ন সচেতনতা প্রোগ্রাম চালু করেছি। আমাদের ওষুধগুলো বাইরে সব জায়গায় পাওয়া যায় না। এজন্য রোগীরা অনেক ক্ষেত্রে কষ্ট পায়। ওষুধ না পাওয়াতে অনেক সময় তারা খায় না।'

প্রায় ৩০ প্রকার ভেষজ উদ্ভিদ নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের তত্ত্বাবধানে দেশের প্রতিটি উপজেলায় ৩৬৪টি ভেষজ বাগান গড়ে তোলা হয়। বাস্তবে এসব বাগান বা মালি কিছুই খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে- গত বছরের অক্টোবরে অভিযোগ করে প্রাচীন চিকিৎসা উন্নয়ন প্রচেষ্টা-প্রাচি।

সুত্র বলছে, দেশে কমপক্ষে ৩২০টি ইউনানী আর আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরি করছে প্রায় ২২০টি কোম্পানি। পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় বাড়ছে ভেষজ ওষুধের চাষাবাদ। প্রায় ৫০০০ বছরের পুরনো ভেষজ চিকিৎসা পদ্ধতি একসময় জনপ্রিয়তা হারালেও এখন আবারও সম্ভাবনা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

হামদর্দ ইউনানী মেডিকেল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ড. মো. মনিরুজ্জামান খান বলেন, 'করোনা মোকাবেলায় সারা পৃথিবীব্যাপী ভেষজ ওষুধের একটা নবজাগরণ শুরু হয়েছে। বিভিন্ন অঞ্চলে ভেষজের ছোট ছোট গ্রাম গড়ে উঠছে।'

মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা, অত্যাধুনিক গবেষণা ও মানসম্পন্ন ওষুধ উৎপাদন এবং অসংখ্য মানুষ স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনে ব্যবহার করায় ইউনানী মেডিসিন সিস্টেমে বিশ্বব্যাপী নেতৃত্বের ভূমিকায় অবস্থান করছে পাশের দেশ ভারত।

আয়ুর্বেদ ইউনানী কোম্পানিগুলো ছাড়াও স্কয়ার, বেক্সিমকো, ইনসেপ্টা ও একমির মতো শীর্ষস্থানীয় ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো ভেষজ ওষুধের চাহিদার ৩০ শতাংশ পূরণ করে। যেখান থেকে বছরে তাদের আয় প্রায় ৮০০ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টদের মতে ভেষজ ওষুধের বাজার থেকে বছরে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার রাজস্ব পায় সরকার। যা সামগ্রিক ফার্মাসিউটিক্যাল খাতের আয়ের এক-দশমাংশ।