দেশে এখন
0

ঢাকায় দৈনিক গড়ে সংসার ভাঙছে ৫০টির বেশি

শহরের আধুনিকায়ন অথবা গ্রামে শিক্ষার হার নিম্নমুখী, কোন কারণটি বিবাহ বিচ্ছেদের হার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এগিয়ে? তা নিয়ে চলে অনেক সমালোচনা। গবেষণায় দেখা যায়, শহরের তুলনায় গ্রামে যেমন বিয়ে বেশি হচ্ছে তেমন তালাক কিংবা দাম্পত্য বিচ্ছেদেও এগিয়ে গ্রামীণ এলাকা। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, গ্রাম কিংবা শহর, বিচ্ছেদ যেখানেই হোক সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেই পরিবারের সন্তানরা।

সম্পর্কের মধুচন্দ্রিমায় অমাবশ্যা নেমে আসার লগ্নের কোনো পূর্বাভাস থাকে না। কখনও কখনও সাংসারিক আবহাওয়ার নিম্নচাপ তৈরি হয়, আবার মেঘ কেটে রোদ উঠে, জোছনায় ভরে আকাশ। কিন্তু কোনো কোনো নিম্নচাপের ঘূর্ণি দুটি মন, দুটি মানুষকে দুই দ্বীপে উড়িয়ে নেয়। ভালোবাসার পূর্ণিমায় অনন্তকালের অমাবশ্যা নেমে আসে। যে মানুষের হাতে হাত রেখে কথা ছিল পাড়ি দেবো সাত জন্ম, সেই মানুষের সঙ্গে এক জন্মটাই পুরোপুরি কাটানো হয় না।

এক নারী বলেন, 'আমার পরিবারে যখন ঝামেলা শুরু হয়ে গেলো। তখন মনে হলো, চলে আসি। কিন্তু সামাাজিক দায়বদ্ধতা বিবেচনা করে আসতে পারিনি। কেননা, আমার পরিবারকে নানানভাবে আজেবাজে কথা বলবে। এসব ভেবেই, এতো টর্চারের পরও আমি কখনও আসতে চাইনি। কিন্তু সবকিছুর তো সীমা থাকে, পরে আর সহ্য করতে পারিনি।'

সম্পর্কে যে ধূলির ঘূর্ণি তৈরি হয়, সেই ধূলিতে থাকে অবিশ্বাস, সংশয়, অশ্রদ্ধা এবং তৃতীয়পক্ষের প্ররোচণা। অস্বাস্থ্যকর ধূলিময় বসত তখন আর ভালোবাসার বসতি বা প্রণয় থাকে না।

এক পুরুষ বলেন, 'বিয়ে এখন শোঅফ হয়ে গেছে। একটা বিয়েতে ৭ থেকে ৮টি প্রোগ্রাম হয়। আর এসবের মাঝে অনেক চাহিদা তৈরি হয়। আবার কাবিন নিয়ে বাড়াবাড়ি হচ্ছে। সবমিলিয়ে বিয়ে আর স্বাভাবিক পর্যায়ে নেই।'

'বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স' অনুযায়ী ২০১১ সালে দেশে তালাকের স্থুলহার ছিল প্রতি হাজারে ০.৭ যা ২০২১ সালে বেড়ে হয়েছে প্রতি হাজারে ১.৪। এর মধ্যে গ্রামে তালাকের প্রবণতা বেড়েছে বেশি। গত বছর গ্রামাঞ্চলে প্রতি হাজারে ১ দশমিক ৫টি আর শহরে হাজারে একটি বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে।

এছাড়া রাজধানীতে প্রতিদিন গড়ে সংসার ভাঙছে ৫০টির বেশি। ২০২৩ সালে ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৭ হাজার ৩০৬টি এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৬ হাজার ৩৯৯টি বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২০ সালে করোনা মহামারির পরপরই বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা বাড়ে আগের থেকেও বেশি। নারীরা কখনও কখনও সংসারে নিজের মর্যাদা না পেয়ে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। অপরদিকে দেনমোহরের লেনদেনে নিপীড়িত হয়েও পুরুষরা বিবাহ বিচ্ছেদের দিকে ঝুঁকছেন বলে মনে করা হয়।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শেখ কানিজ ফাতেমা বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীরাই বেশি আসে। একটা বিষয় নারী মানেই ভুক্তভোগী, তার পাশে আছি বিষয়টি এমন হয়ে গেছে। কিন্তু পুরুষের সংখ্যাও কম নয়, পুরুষও আসছে। নারীরা হয়তো যৌতুকের কারণে ডিভোর্স নিচ্ছে। পুরুষদের কাছে আবার বেশি ডিমান্ড করা হচ্ছে।’

কাজী মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘শরীয়াতের ভাষায় নারী-পুরুষ দেনমোহর নির্ধারণ করবে। একজন পুরুষ তার সার্মথ্য অনুযায়ী মোহর ঠিক করতে পারে। কিন্তু এখন পরিবারের পক্ষ থেকে ৫ থেকে ১০ লাখ দেনমোহর ঠিক করা হচ্ছে।’

এছাড়া সমাজে সহিষ্ণুতা হ্রাস পাওয়ায় বিবাহ বিচ্ছেদের হার বেশি বলে মনে করেন সমাজ বিশ্লেষকরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. নেহাল করিম বলেন, ‘নারী নাকি পুরুষরা বেশি বিচ্ছেদ চায়, এটি একটি বিষয়। নারীরা যদি চায়, তাহলে বুঝতে হবে তারা স্বাবলম্বী হয়েছে। সে কারণে তাদের হারানোর কিছু নেই, একটা জেদ বা আত্মসম্মান থাকে তো। এ কারণেও বিচ্ছেদ বেড়েছে। এর পেছনে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণও আছে।

নগর বা গ্রামের যাপন, কোথাও আর একলার ঘানি টেনে নেওয়ার জীবন নেই। দুইয়ে মিলে সংসারের চাহিদা মেটাতে হয়। কোনো কোনো দম্পতির সংসারের চৌহুদ্দিটা বড় হয়। তাদের ওপর অন্যদের নির্ভরতা থাকে। যা কখনও কখনও স্বামী-স্ত্রী উভয়ের ওপরই বাড়তি চাপ তৈরি করে। সেই চাপ, ব্যক্তিত্বের সাংঘর্ষিক অবস্থান, পছন্দ-অপছন্দের তালিকা বড় হতে থাকা এবং কখনও কখনও জৈবিক চাহিদার হিসেব-নিকেষ সম্পর্কে বিচ্ছেদের পর্দা নামিয়ে দেয়। তবে টানাপোড়নের সময় স্বামী-স্ত্রী যে মানসিক বিপর্যস্ততার মধ্যে থাকে, সে সময় তাদের মনের যত্ন নেয়া দরকার বলে মনে করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক (সাইকিয়াট্রি) ডা. মেখলা সরকার।