পৃথিবীর ৪ ভাগের ৩ ভাগই পানি। কিন্তু এই বিশাল জলরাশির কতটা সুপেয়? বিশ্বের মোট পানির প্রায় ৯৭ শতাংশই লবণাক্ত। পানের যোগ্য মাত্র আড়াই থেকে ৩ শতাংশ। বরফ আর তুষার বাদ দিলে তো ভূগর্ভস্থ সুপেয় পানি ১ শতাংশেরও কম। সেটিও আবার দিনে দিনে কমছে।
উপকূলের জেলাগুলোয় গেলে সেটি আরও তীব্রভাবে টের পাওয়া যায়। এখানকার বাসিন্দাদের প্রতিদিনের প্রধান কাজ যেন সুপেয় পানি সংগ্রহ করা। কোনো এলাকায় ৫ থেকে ৭ বাড়ি ঘুরে একটি টিউবওয়েলের দেখা মিললেও কারো জোটেনা সেটিও। তাতে সড়কের পাশে কিংবা বাজারের চাপকলটাই ভরসা।
স্থানীয় একজন বলেন, 'খালের মতো আছে। সেটা কতভাবে পার হয়ে পানি এনেছি তার হিসেব নেই। নরমাল পানি ওঠে আবার ময়লা পানিও ওঠে চাপকলে। ময়লা পানি কলস ভরে নিয়ে রাখলে ময়লা নিচে চলে যায় তখন আমরা পানি খাই।'
পুকুর থেকে কলসে পানি সংগ্রহ করছেন। ছবি: এখন টিভি
পটুয়াখালীসহ দক্ষিণ উপকূলের মাটি ও পানিতে লবণাক্ততা বাড়ছে ক্রমশ। সংকুচিত হচ্ছে বিশুদ্ধ পানির উৎস। যেখানে আগে মিঠা পানি পাওয়া যেত ৬০ থেকে ৭০ ফুট গভীরে। সেটি এখন গিয়েছে ঠেকেছে ২০০ ফুটের নিচে।
মৃত্তিকা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বরিশালের নদ নদীর প্রতি সেন্টিমিটার পানিতে লবণের পরিমাণ ২ হাজার থেকে ১৪ হাজার মাইক্রোসিমেন্স। যেখানে লবণাক্ততার সহনীয় মাত্রা ৭৫০ মাইক্রোসিমেন্স। তাতে এই অঞ্চলের ৮৫ শতাংশ মানুষই ব্যবহার করছেন লবণাক্ত পানি।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিটি হেলথ অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক লিটন চন্দ্র সেন বলেন, '৮৫ শতাংশ মানুষ তাদের খাবার পানি হিসেবে টিউবওয়েলের পানি ব্যবহার করছে। থালা-বাসন ধোয়া, হাত ধোয়ার কাজে তারা পুকুর বা খালের পানি ব্যবহার করছে।'
পটুয়াখালীর বাদুড়তলী গ্রামের বেশিরভাগ বাড়িতেই রয়েছে বিশুদ্ধ পানির সংকট। তবে এমন ছোট বড় প্রতিটি দোকান খুঁজলে পাওয়া যাবে বোতলজাত পানি। উপকূলীয় অঞ্চলসহ সারাদেশে সুপেয় পানির সংকট বাড়ার পাশাপাশি সমানুপাতিক হারে বাড়ছে বোতলজাত পানির চাহিদা। গত চার দশকে এটি কিভাবে নিত্যপণ্য হয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছাল?
বিশুদ্ধ পানির সংকট আর মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ায়, গত ৪ যুগে গড়ে উঠেছে বোতলজাত পানির বাণিজ্য। শুরুতে ডানকান, এভারেস্টর মতো বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে পানির ব্যবসা শুরু করলেও বর্তমান দেশে পানি বিক্রির অনুমোদন রয়েছে ৫১টি প্রতিষ্ঠানের।
গবেষণাগরে বিশুদ্ধ পানি তৈরির প্রক্রিয়া চলছে। ছবি: এখন টিভি
সংরক্ষিত পানির আর্সেনিক, আয়রন ও ভারী ধাতু মুক্ত করা হয় আলাদা আলাদা ট্যাংকে। অন্তত ১০টি ট্যাংকের মধ্যে হয় বিশুদ্ধিকরণ। স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে ওজোনেশন ও রিভার্স অসমোসিসের মতো প্রক্রিয়াগুলো।
পানির পিএইচ, দ্রবীভূত অক্সিজেন, টিডিএস ও হার্ডনেস পরীক্ষা হয় ল্যাবে। কেমিক্যাল ও মাইক্রোবায়োলজিকাল টেস্ট শেষই পাঠানো হয় ফিলিং লাইনে।
সিটি গ্রুপের ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টের কেমিস্ট বিদুর চন্দ্র রায় বলেন, 'প্রাথমিক অবস্থায় প্রতি বেজেই আমরা কেমিক্যাল এবং মাইক্রোবায়োলজিকাল টেস্ট করে থাকি। যদি কখনও কোনো ধরণের কনফিউশন থাকে, তবে আমরা আবার নতুন করে পরীক্ষা করি।'
ফিলিং, লেভেলিং ও প্যাকেজিং সব অত্যাধুনিক মেশিনে চলে। বড় কারখানাগুলোতে দিনে উৎপাদন হয় ৫০০ থেকে ৬০০ টন পানি। অন্তত ২০ থেকে ২৫টি ধাপ পেরিয়ে ভোক্তার হাতে যায় পানি।
সিটি গ্রুপের ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টের ম্যানেজার মাহবুব আলম বলেন, 'আমাদের এখানে প্রতিদিন প্রডাকশন ক্যাপাসিটি ৫০০ মেট্রিকটন। এটা আমরা খুব কম জনশক্তি দিয়েই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারি।
বিভিন্ন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে তৈরি হচ্ছে বিশুদ্ধ পানি। ছবি: এখন টিভি
বছরে দেশে বোতলজাত পানির চাহিদা প্রায় ১০ লাখ টন। তাতে বাণিজ্যিকভাবে মাসে উৎপাদিত হয় ১০ থেকে ১২ কোটি বোতল। বছরে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে এই চাহিদা।
সিটি গ্রুপের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর জাফর উদ্দিন সিদ্দিকী বলেন, 'পৃথিবীর দেশে দেশে বোতলের পানির চাহিদা বেড়ে উঠছে।
ব্যাপক চাহিদায় গত এক বছরে অনেক কোম্পানি বাড়িয়েছে পানির দাম। স্থানীয়ভাবে গড়ে উঠেছে মানহীন প্রতিষ্ঠানও। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে কতটা মনোযোগী সংশ্লিষ্টরা?
বিএসটিআই উপ পরিচালক রেজাউল হক বলেন, ''৪৩টি প্যারামিটার আমরা পরীক্ষা করি। সবগুলো প্যারামিটারে পাস করলে তবেই আমরা ওই কমিটির কাছে প্লেস করি।'
বিশুদ্ধতার মানদণ্ড ঠিক না থাকায় বিএসটিআই গত ১ বছরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছে ১৬ লাখ টাকা। সিলগালা করা হয় ৫টি কারখানা।