দেশে এখন
0

নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ স্তর, সুপেয় পানি পেতে হাহাকার

জীব ও জীবনের সূত্র ও সূচনায় জল। খাদ্যের অভিন্ন অংশ। পানি কি শুধু তৃষ্ণা মেটায়? যাপিত জীবনের সঙ্গে পানির নিবিড় যৌথতা। প্রাণ-প্রকৃতির বিকাশ কিংবা খাদ্য উৎপাদন, পানির বিকল্প নেই কোথাও।

জলের সঙ্গে সখ্যতা নিয়ে গড়ে ওঠে জীবিকাও। কিন্তু এই জলের জীবন ফুরলে কি জীবন বাঁচে?

একজন মাঝি বলেন, 'পানিতেই আমাদের জীবন। পানিই আমার জীবিকা। পানি ভালো থাকুক এটাই আমাদের চাওয়া।'

প্রায় ২ কোটি মানুষের শহর ঢাকা। যেখানে নাগরিক চাহিদার শীর্ষে সুপেয় পানি। অনাদিকাল থেকে যে পানির অপর নাম জীবন, তার জন্য ছুটতে হয় নিত্যদিন। তবুও পানি নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই।

বাড়ির নলকূপ থেকে পানি তোলার আপ্রাণ চেষ্টা সাভারের ভাকুর্তা এলাকার আজমেরী বেগমের। কিন্তু পানির দেখা পাওয়া যেন চাতকের অপেক্ষা। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এই কষ্ট তাদের নিত্যদিনের।

সাভারের ভাকুর্তা এলাকার আজমেরী বেগম নলকূপ থেকে পানি তোলার চেষ্টা করছেন। ছবি: এখন টিভি

আজমেরী বেগম বলেন, 'এই কলে তিন বছর ধরে ঠিকমতো পানি আসে না। কয়েকবার পানির পাম্প বসিয়েও পানি পাওয়া যায় না। এবার সাবমারসিবল বসাইছি। সেটাতেও পানি আসে না।'

তার মতো এ এলাকার অনেক বাড়িতে গভীর নলকূপই একসময় ছিল ভরসা। কিন্তু এখন আর সে দৃশ্য নেই। নলকূপে পানি না মেলায় অনেকেই লাখ টাকা খরচ করে সাবমারসিবল পাম্প বসিয়ে পানির চাহিদা মেটাচ্ছেন তারা। কিন্তু তাতে ব্যয় বেড়েছে অনেকগুণ।

ওয়াসার পানির অগ্রাধিকার থাকলেও পর্যাপ্ত পানি পাচ্ছেন না তারা। এলাকাবাসীর অভিযোগ, অনেকের বাড়িতে ওয়াসা সংযোগ দিলেও পানি সরবরাহ দেয় না ঠিকঠাক।

স্থানীয় একজন বলেন, 'আগে আমরা চাপকল দিয়ে পানি নিতাম আমাদের পানির বিল লাগতো না। এই সাবমারসিবল বসানোর পর থেকে প্রতিমাসে আমাদের ১ হাজার টাকার মতো বিদ্যুৎ বিল আসে। আমাদের ওপর অতিরিক্ত চাপ হয়ে গিয়েছে।'

সুপেয় পানি সরবরাহ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ওয়াসার। নগরের পানি সংকট মোকাবিলা করাই যাদের প্রধান কাজ। সে লক্ষ্যেই রাজধানীর অদূরে সাভার ও কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় পাম্প স্থাপন করেছে ওয়াসা। যেখান থেকে দিনে প্রায় ১৫ কোটি লিটার পানি তুলতে বসানো হয়েছে ৪৬টি পাম্প। যার ফলে ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। ব্যহত হচ্ছে সেচ কাজসহ গৃহস্থালির কাজকর্ম।

গেল কয়েক বছর আগে সাভারের ভাকুর্তা এলাকায় পানির খনির সন্ধান পায় ঢাকা ওয়াসা। এরপরই প্ল্যান্ট নির্মাণ করে এ অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে তা সরবরাহ করতে শুরু করে ঢাকার মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায়। আর বিপত্তি তখনই শুরু হয়। ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। গভীর নলকূপগুলোতে মিলছে না পানি। ব্যাহত হচ্ছে সেচ কাজসহ গৃহস্থালি কাজকর্ম। পানির অভাবে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠে কমে গেছে চাষাবাদ। সংকটে কয়েক লাখ মানুষ।

কৃষি জমিতে সেচ পাম্পের মাধ্যমে পানি দেয়া হচ্ছে। ছবি: এখন টিভি

স্থানীয় একজন কৃষক বলেন, 'আগে পানির স্তর ওপরে ছিল। মাটি থেকে রস পাওয়া গেছে। যার জন্য ফসল ভালো হইছে। এখন আমরা ভালো ফসল পাই না। আর ২ থেকে ৩ বছর গেলে এ পানিও মনে হয় পাবে না। পানির অভাবে ফসর মরে যাবে।'

পানির এই সমস্যা দূর করতে কী উদ্যোগ ওয়াসার? সাময়িক সমস্যা হলেও স্তন্যপায়ীদের জন্য পাইপলাইনে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে বলে দাবি ওয়াসার চেয়ারম্যান তাসকিম এ খানের।

তিনি বলেন, 'পানি তোলার সময় একটু সমস্যা হবেই। তার বদলে আমরা তাদের পানির লাইন করে দিচ্ছি। একেবারে পাইপ লাইন দিয়ে পানি গ্রামের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এতে তাদের সে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।'

সুপেয় পানি প্রাপ্তির সুযোগকে মানবাধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছে জাতিসংঘ। ওয়ার্ল্ড ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট-২০২৩ এর তথ্য বলছে, বিশ্বের প্রায় ২৬ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি পায় না। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের প্রায় ৭০০ কোটি মানুষ এই সংকটে পড়তে পারে।

পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবার জন্য সুপেয় পানির সুষম বণ্টন জরুরি। খাদ্য নিরাপত্তা বজায় রাখতে দেশের অভ্যন্তরীণ পানি ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে সমন্বয় আনা জরুরি।

পানি ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত বলেন, 'প্রকৃতির ওপরে পানির নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। বিভিন্ন জায়গা থেকে পানি পাম্প করে ঢাকার জন্য নিয়ে আসছি। যেখান থেকে পানি পাম্প করছি সেখানে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। ভবিষ্যতে পানি পাওয়ার তারতম্য ঘটবে। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টিপাত কখন হবে সেদিকে বিরাট পরিবর্তন হবে। সবকিছু মিলিয়ে পানি ব্যবস্থাপনাকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে।'

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় জানায়, পানি সরবরাহে নদী থেকে পানি উত্তোলন ও পরিশোধন ব্যবস্থায় বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তারপরেও পানি সংকট সংক্রান্ত যে কোন অভিযোগ পেলে তা দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হবে।

স্থানীয় সরকার, সমবায় ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, 'কিছু প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও ঢাকাতে পানি শোধন করে সরবরাহ করা যতটা সহজ এখন অন্যান্য শহরে কিন্তু এর চেয়ে অনেক বেশি। দেশের সকর মানুষের জন্য পানি দেয়ার জন্য কাজ করছি।'

পানির সঞ্চিত ভাণ্ডার অফুরান থাকুক। বাধাপ্রাপ্ত না হোক পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। জলতরঙ্গে জীবনকে অবগাহন করে তৈরি হোক সুরের ঐকতান।

এসএস