তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে মৃত্যুসংবাদ নিশ্চিত হওয়ার পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেমে আসে শোকের ছায়া। সমর্থকদের কাছে তিনি ‘জাতীয় বীর’, প্রতিবাদী রাজনীতির এক প্রতীক। বন্ধু–শত্রু নির্বিশেষে সবাই একমত, ওসমান হাদি ছিলেন সময়ের সাহসী এক চরিত্র। তার মৃত্যুর খবরে শোক জানিয়েছে বিএনপি-জামায়াত-এনসিপিসহ দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দল।
ইনকিলাব মঞ্চের ফেসবুক পেজে এক বার্তায় বলা হয়, ‘ভারতীয় আধিপত্যবাদের মোকাবিলায় মহান বিপ্লবী ওসমান হাদিকে আল্লাহ শহিদ হিসেবে কবুল করেছেন।’
গুলিবিদ্ধ থেকে প্রবাসের আইসিইউ
গত ১২ ডিসেম্বর রাজধানীর বিজয়নগরে প্রকাশ্য দিবালোকে দুর্বৃত্তের গুলিতে গুরুতর আহত হন ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য প্রার্থী ওসমান হাদি। আশঙ্কাজনক অবস্থায় প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, পরে এভারকেয়ার হাসপাতালে আইসিইউতে রাখা হয় তাকে। চিকিৎসকদের ভাষায়, তার অবস্থা ছিল ‘অত্যন্ত সংকটজনক’।
উন্নত চিকিৎসার আশায় সোমবার (১৫ ডিসেম্বর) এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তাকে নেয়া হয় সিঙ্গাপুরে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতাল; দীর্ঘ এক যাত্রা, যার শেষটা আর দেশে ফেরা হলো না। তিন দিনের জীবন-মৃত্যুর লড়াই শেষে হার মানেন এই তরুণ নেতা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জন ডা. আব্দুল আহাদ শোকবার্তায় বলেন, ‘আমাদের প্রাণপ্রিয় জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর শরিফ ওসমান হাদি ভাইকে আল্লাহ শহিদ হিসেবে কবুল করুন। তার পরিবার যেন এই শোক সইতে পারে, সেজন্য সবাই দোয়া করবেন।’ তিনি জানান, শুক্রবার সকালে হাদির মরদেহ ঢাকায় আনা হবে।
ঝালকাঠির নলছিটি থেকে ঢাকার রাজপথ
ঝালকাঠির নলছিটিতে জন্ম নেয়া ওসমান হাদির শৈশব কেটেছে এক মাদ্রাসা-শিক্ষক বাবার স্নেহছায়ায়। বাবা মাওলানা আব্দুল হাদি ছিলেন স্থানীয় মাদ্রাসার শিক্ষক। নেছারাবাদ কামিল মাদ্রাসায় শিক্ষাজীবনের শুরু, সেখান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি। ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন:
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন হাদি। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তবে কোনো মূলধারার রাজনৈতিক দলে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন না। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কাজ করেছেন, লিখেছেন বই। জীবন সংগ্রামে একসময় প্রাইভেট পড়িয়েছেন, শিক্ষকতা করেছেন কোচিং সেন্টার সাইফুরসে। সবশেষ তিনি ইউনিভার্সিটি অব স্কলারস নামের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছিলেন।
জুলাই অভ্যুত্থান ও ‘ইনকিলাব মঞ্চ’
২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানই ওসমান হাদিকে এনে দেয় জাতীয় পরিচিতি। সাহসী ভূমিকা, ঝাঁঝালো বক্তব্য আর আপসহীন অবস্থানের কারণে অল্প সময়েই তিনি হয়ে ওঠেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে তার হাত ধরেই গড়ে ওঠে রাজনৈতিক–সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম ‘ইনকিলাব মঞ্চ’। সংগঠনটির ঘোষিত লক্ষ্য, সব ধরনের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা–সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ।
এই মঞ্চ থেকে তিনি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি, জুলাই শহিদদের স্বীকৃতি, অপরাধীদের বিচার এবং ‘জুলাই চার্টার’ ঘোষণার দাবিতে রাজপথ ও সভা-সমাবেশে সরব ছিলেন। টকশো, সামাজিক মাধ্যম, সবখানেই তার উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।
ছিলেন জনপ্রিয়তার শীর্ষ, পেয়েছেন হুমকি
স্পষ্টভাষী হাদির বক্তব্য যেমন সমর্থকদের কাছে তাকে জনপ্রিয় করে তোলে, তেমনি তার কিছু মন্তব্য ও ভাষা ব্যবহার নিয়ে সমালোচনাও হয়েছে। ধানমণ্ডি-৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ভাঙচুর, গোপালগঞ্জে এনসিপি নেতাদের ওপর হামলার পর দেয়া বক্তব্য—এসব ঘটনায় তার কিছু শব্দচয়ন নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়।
আরও পড়ুন:
তবু তিনি পিছিয়ে যাননি। বরং আরও উচ্চকণ্ঠ হয়েছেন। গত নভেম্বরেই ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে দাবি করেন, দেশি–বিদেশি অন্তত ৩০টি নম্বর থেকে তাকে হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছে। বাড়িতে আগুন দেয়া, মা–বোন–স্ত্রীকে ধর্ষণের হুমকির কথাও জানান তিনি। লিখেছিলেন, ‘জীবননাশের আশঙ্কা সত্ত্বেও ইনসাফের লড়াই থেকে পিছিয়ে যাব না।’
ভোটের মাঠে নামার আগেই থেমে গেল পথচলা
ঢাকা-৮ (মতিঝিল, পল্টন, রমনা ও শাহজাহানপুর) আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন হাদি। মুড়ি-বাতাসা বিতরণ, ভোররাতে লিফলেট বিলি, ডোনেশনের মাধ্যমে ফান্ড সংগ্রহ—ভিন্নধর্মী প্রচারণায় তিনি নজর কাড়েন।
কিন্তু তফসিল ঘোষণার পরদিনই বন্দুকধারীর গুলিতে আহত হন তিনি। সেই গুলিই শেষ পর্যন্ত কেড়ে নিলো তার প্রাণ।
নীরব প্রস্থান, প্রশ্নের রেশ
ওসমান হাদির মৃত্যু শুধু একজন রাজনৈতিক নেতার মৃত্যু নয়; এটি প্রশ্ন রেখে গেল বাংলাদেশের রাজনীতির নিরাপত্তা, সহনশীলতা ও ভবিষ্যৎ পথচলা নিয়ে। তার অনুপস্থিতি এক অপূরণীয় শূন্যতা তৈরি করবে বলেই অনুমেয়।
এক সময় যিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে হত্যা করা হতে পারে, তবু আমি পিছাব না’। শেষ পর্যন্ত সেই আশঙ্কাই সত্যি হলো। কিন্তু থেমে গেলেও তার কণ্ঠ, তার বক্তব্য আর তার সাহসী অবস্থান থেকে যাবে সময়ের স্মৃতিতে।
বিদায় শরিফ ওসমান হাদি—এক সাহসী, সত্যভাষী তরুণ নেতা।





