ভবন তোলার দৌড়ে হাঁসফাঁস করছে ঢাকা। ভবনের ছায়ায় হারিয়ে যাচ্ছে আলো-বাতাস, এক টুকরো খোলা আকাশের জীবন। নিচে যানজট, ওপরে কংক্রিটের প্রতিযোগিতা।
এ বিশৃঙ্খল ও অব্যবস্থাপনার নগরীকে নতুন করে নিয়মের মধ্যে আনতে ২০০৮ সালে ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) নিয়ে আসে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), যার লক্ষ্য ছিল টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদী নগর পরিকল্পনা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে নগর তার যে গতিবিধির পরিবর্তন ঘটিয়েছে, তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে ২০২২ থেকে ২০৩৫ সাল অব্দি নতুন ড্যাপের আহ্বান করে রাজউক।
গেলো ১৯ অক্টোবর ‘ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০২৫’-এর নীতিগত অনুমোদন দেয় ড্যাপ রিভিউ সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি। এখানে সবুজ খোলা জায়গা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে ফ্লোর এরিয়া রেশিও (ফার)। আর এ ফারের মানের ওপর ভিত্তি করেই জানা যায় ওই এলাকায় সর্বোচ্চ কত উচ্চতার ভবন নির্মাণ করা যাবে।
সংশোধিত ড্যাপে মিরপুর, মহাখালী, মোহাম্মদপুর, পুরান ঢাকা ও খিলগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকায় বাড়ানো হয়েছে উচ্চতার সীমা। এর মধ্যে কড়াইল, খিলক্ষেত আর মিরপুর ডিওএইচএসে উচ্চতাসীমা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।
আগে যেখানে অনুমোদন ছিল পাঁচ তলা ভবনের, সেখানে এখন নির্মাণ করা যাবে ১০ থেকে ১১ তলা পর্যন্ত। তবে গুলশান, বনানী ও ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় কিছুটা কমেছে ফারের মান।
এরপরও খুশি নন আবাসন ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি, নগরীর বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আবাসন চাহিদা মেটাতে আরও উঁচু ভবনের প্রয়োজন।
রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী প্রতিনিধি আবদুল লতিফ বলেন, ‘ডেভেলপারদের জন্য বা ভূমি মালিকদের জন্য অস্বস্তি রয়ে গেছে। যেখানে আরেকটু এলুমিনেট হতে হবে। কারণ ঢাকার জমির দাম অনেক বেশি। আপনি যদি ফ্ল্যাট বানিয়ে বিক্রি করে জমির ভ্যালু না পান তাহলে তো আপনি ডেভেলপ করতে চাইবেন না।’
আরও পড়ুন:
ভূমিকম্প, আগুন ঝুঁকিতে থাকা এই বিপদের নগরীতে সংশোধিত ড্যাপ নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। কমিটিতে থাকা তাদের পরামর্শ মানা হয়নি। ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতেই পরামর্শ অগ্রাহ্য করার অভিযোগ তাদের। এমনকি ঢাকার আশপাশে কৃষিজমিকে নালা দেখিয়ে ভবন তোলার বৈধতা দেয়ার অভিযোগও তাদের।
পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, ‘আমি মনে করি এখানে বিশাল একটা অন্যায় কার্যক্রম হয়েছে সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে। একটা বিতর্ক রাখা হয়েছিল উঁচু ভবন-নিচু ভবন। মনে রাখা দরকার, ছোট ছোট রাস্তায় উঁচু ভবনগুলো অবৈধ। ওই বিতর্কের মধ্যে দিয়ে অসংখ্য বন্যাপ্রবণ এবং কৃষিজমি অনুমোদন দেয়া হয়েছে বিশেষ বিবেচনায় এগুলোর প্রত্যেকটা গর্হিত অপরাধ।’
পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মাদ খান বলেন, ‘ড্যাপকে সংশোধনের নাম দিয়ে যে উপদেষ্টা পরিষদে জিনিসটাকে নীতিগতভাবে অনুমোদনের চেষ্টা করা হলো, সেটা পুরোটাই আবাসন ব্যবসায়ীদের চাপে।’
অভিযোগের উত্তর জানতে রাজউক ভবনে যায় এখন টিভি। সেখানে গিয়ে দেখা মেলে, চেয়ারম্যানের টেবিল ঘিরে আবাসন ব্যবসায়ীদের ভিড়। চেয়ারম্যানের দাবি, বাড়তি জনসংখ্যার চাহিদা ও আবাসনের বাস্তবতা মেনেই নির্ধারিত হয়েছে নতুন ফার।
রাজউক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ রিয়াজুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করেছি সবাইকে অ্যাকোমোডেট করার। তবে এটা ঠিক যে, মূল পার্থক্যটা সব শেষে গিয়ে দুই জায়গায় দাঁড়িয়েছে। ডেভেলপারদের কিছু দাবি ছিল আবার প্ল্যানারদের কিছু দাবি ছিল। আসলে বাস্তবতার নিরিখে আমরা একটা প্রস্তাব দিয়েছি এবং এই প্রস্তাবটা কিন্তু তাদেরও ছিল। প্ল্যানার্স, আর্কিটেক্ট, ইঞ্জিনিয়ার সবারই এ প্রস্তাব ছিল।’
পরিকল্পনায় কোনো অসঙ্গতি থাকলে ভবিষ্যৎ সংশোধনীতে তা ঠিক করা হবে বলেও জানান তিনি।




