বাথ পার্টির হাত ধরে সেই ১৯৭১ সালে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন হাফিজ আল-আসাদ। তারপর ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতা কুক্ষিগত তার পরিবারের হাতেই। হাফিজের ছেলে বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদই ক্ষমতা আঁকড়ে আছেন ২০০০ সাল থেকে। দুই যুগের বেশি সময় পেরিয়ে বিদ্রোহীদের নাটকীয় উত্থানে টলে গেছে সিংহাসন। ‘নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক’ তকমা পাওয়া আসাদকে বাঁচাতে হাত বাড়াবে কে?
একযুগের বেশি সময় ধরে চলতে থাকা গৃহযুদ্ধে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হাজার হাজার পরিবার। বিদ্রোহীরা এলাকার পর এলাকা দখল করে নিতে থাকায় দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে বয়ে যাচ্ছে আনন্দের বন্যা।
ক'দিন আগেও শক্ত হাতে আলেপ্পোর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা আসাদ সেনারা পিছু হটছে আরও অনেক এলাকা থেকে। যুদ্ধক্ষেত্রের দু'পাশে পরিবারের সদস্যদের এক হওয়ার অপেক্ষার অবসান ঘটছে। বিদ্রোহীদের সাথে জয় উদযাপন করছেন সাধারণ মানুষও।
তরুণ যোদ্ধারা এসে আমাদের উদ্ধার করার আগ পর্যন্ত ঘর থেকে বের হইনি। এখন তাদের সাথে বিজয় উদযাপন করছি, তাদের স্বাগত জানিয়েছি। তারা আমাদের দেশের মানুষ, আমাদের ভাই। আল্লাহ'র ইচ্ছায় এরপর তারা দামেস্কেও পৌঁছাবে।
এক সপ্তাহে চারটি শহর দখলের পর সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের লক্ষ্য এখন দামেস্ক। কিন্তু অর্ধশতকের বেশি সময়ের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা একটি পরিবারের শাসনের অবসান, ক্ষমতার পালাবদল আসলে কতটা সহজ? বিশেষ করে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখা আসাদ সরকারকে যেখানে সমর্থন দিচ্ছে ইরান আর রাশিয়া।
পঞ্চম শহর হোমস জয়ের লক্ষ্যে এগোতে থাকা বিদ্রোহীরা দেশের দক্ষিণে সরকারি বাহিনীকে পুরোপুরি কোণঠাসা করে ফেলেছে। এমন সময়েই সিরিয়া সরকারকে ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোনসহ সব ধরনের সামরিক সহযোগিতা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে তেহরান। বিদ্রোহীদের অতর্কিত আক্রমণে সিরীয় সরকারের প্রতিরোধ ভেঙে পড়লেও শেষ পর্যন্ত কী ঘটবে- তা এখনও বোঝার উপায় নেই, বলছেন বিশ্লেষকরা।
চ্যাথাম হাউজ মিডল ইস্ট এক্সপার্ট ডিআর হাইদ হাইদ বলেন, ‘এরপরে কী ঘটবে বা আসলে শেষ পর্যন্ত কী ঘটতে যাচ্ছে, এখনই সেসব নিশ্চিতভাবে বলা বেশ কঠিন। এই মুহূর্তে এটা বলা যায় যে হোমসে যেভাবে সংঘাত চলছে, তাদের এই শহরটি দখলেরই সক্ষমতা বিদ্রোহীদের আছে। হোমস জিতলে তারা রাজধানী দামেস্কের দিকে আরও এগিয়ে যাবে। রাজধানী জয়ে তাদের সম্ভাবনাও বাড়বে।’
২০১১ সালে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর দেশের উত্তরাঞ্চলের বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল আসাদ সরকার। কিন্তু রাশিয়া, ইরান এবং লেবাননের সশস্ত্র রাজনৈতিক সংগঠন হিজবুল্লাহর সমর্থনে ২০১৬ সাল থেকে আলেপ্পোসহ পুরো অঞ্চলে ফের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে সিরীয় সরকারের সেনাবাহিনী।
কিন্তু এক বছরের বেশি সময় ধরে ইসরাইলের সঙ্গে ইরান ও হিজবুল্লাহর যুদ্ধ এবং আড়াই বছর ধরে ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার যুদ্ধ চলমান বলে সিরিয়ায় সম্প্রতি আসাদ সরকারের মিত্র বাহিনীগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। এ সুযোগ লুফে নিয়ে বিদ্রোহীদের নাটকীয় উত্থান, যা দামেস্ক পর্যন্ত ধরে রাখতে হলে থাকতে হবে ব্যাপক পূর্বপ্রস্তুতি- মত বিশ্লেষকদের।
চ্যাথাম হাউজ মিডল ইস্ট এক্সপার্ট ডিআর হাইদ হাইদ বলেন, ‘রাজধানী জয় করতে চাইলে, দামেস্কের কাছে পৌঁছাতে চাইলে বিদ্রোহীদের ভীষণ সংঘবদ্ধ থাকতে হবে। বিভিন্ন দিক থেকে আঞ্চলিক গোষ্ঠীগুলোর ওপর হামলা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি নিজেদের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুর যোগানও স্বাভাবিক রাখতে হবে।’
১৩ বছর ধরে গৃহযুদ্ধ চলতে থাকার মধ্যে সাম্প্রতিক সহিংসতায় নভেম্বর থেকে সিরিয়ায় নতুন করে প্রায় তিন লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে বলে শুক্রবার জানিয়েছে জাতিসংঘ। এ সংখ্যা পৌঁছাতে পারে ১৫ লাখেও।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক পর্যবেক্ষক সংস্থা সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস জানিয়েছে, এরই মধ্যে হোমস ছেড়ে পালাতে শুরু করেছেন বাসিন্দারা, এগিয়ে যাচ্ছেন ভূমধ্যসাগর উপকূলীয় লাটাকিয়া আর টার্টুস শহরের দিকে।