মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে বাজার ধরতে দশকের পর দশক ধরে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে কোমল পানীয় ব্র্যান্ড কোকাকোলা আর পেপসি। কিন্তু গাজায় ইসরাইলি সেনা অভিযান শুরুর পর থেকেই এই বাজার যেন কর্পুরের মতো উবে গেছে।
বাজার বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান নিলসেন আইকিউ বলছে, ঠিক কি পরিমাণ লোকসান হয়েছে এ দুই কোম্পানির, তা জানা না গেলেও বছরের প্রথমার্ধে পশ্চিমা বিভিন্ন ব্র্যান্ড মধ্যপ্রাচ্যে ৭ শতাংশ বাজার হারিয়েছে।
ইসরাইলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমাগত একতরফা সমর্থনের কারণেই মূলত কোকাকোলা আর পেপসিকোকে এতো বড় পরিসরে বয়কট করেছে মধ্যপ্রাচ্য। ফলে ধস নেমেছে কোকাকোলা, পেপসিকোর বাজারে।
একজন জানান, কোকাকোলা আর পেপসির বিক্রি কমে গেছে। যে কারণে কোকাকোলা রমজানে মূল্যছাড় দিয়েছিলো। আরেক অধিবাসী জানান, আমিও এসব পণ্য বর্জন করেছি। আমি অন্য কোমল পানীয় পান করছি। বিদেশি পণ্য বর্জন করে মিশরীয় পণ্য কিনছি। কিন্তু সমস্যা হলো আমদানি করা পণ্যের তুলনায় মিশরের পণ্যের দাম বেশি।
২০২৩ সালে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় ৬শ' কোটি ডলার আয় করেছিলো পেপসিকো। একই বছর ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য আর আফ্রিকা থেকে কোকাকোলার আয় ছিলো ৮শ' কোটি ডলার।
অথচ গেলো বছরের অক্টোবরে গাজায় ইসরাইলি সামরিক অভিযান শুরুর পর মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে কমে গেছে কোকাকোলা আর পেপসিকোর কোমল পানীয় বিক্রির পরিমাণ। যদিও কোকাকোলা বলছে, ইসরাইলকে কোনভাবেই সহযোগিতা করেন না তারা। অন্যদিকে এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করেনি পেপসিকো।
কোমল পানীয়র বড় বড় ব্র্যান্ডগুলো মুসলিম বিশ্বের লাখ লাখ ভোক্তার কাছে সবসময় বেশ জনপ্রিয় ছিলো। ইসরাইলে ১৯৬০ সালে কোকাকোলা কারখানা চালুর পরই আরব লিগ এই কোম্পানিকে বয়কট করে, যা অব্যাহত থাকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত।
যে কারণে ১৯৯০ সালে ইসরাইলে এসেও মধ্যপ্রাচ্যে বড় পরিসরে পরিচিতি পায় আরেক কোমল পানীয় ব্র্যান্ড পেপসিকো। কিন্তু ২০১৮ সালে ৩শ' ২০ কোটি ডলারের বিনিময়ে ইসরাইলের সোডাস্ট্রিম কিনে নিয়ে বয়কটের শিকার হয় পেপসি।
যদিও মিশর ও পাকিস্তানে পেপসির তুলনায় কোকের জনপ্রিয়তা বেশি, কিন্তু এখন দুই ব্র্যান্ডই গোটা মধ্যপ্রাচ্যে বাজার হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছে স্থানীয় কোমল পানীয় ব্র্যান্ডগুলোর কাছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের নির্বিচার সেনা অভিযান।
কোকাকোলায় ২৮ বছর চাকরির পর ২০২০ সালে চাকরি ছেড়ে দেয়া প্রতিষ্ঠানটির সাবেক নির্বাহী জানান, ২০২৩ সালের তুলনায় চলতি বছর মিশরের একটি কোমল পানীয়র রপ্তানি মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। যে পানীয় বিক্রি হচ্ছে ২১ টি দেশে।
ভি সেভেন কোম্পানির স্বত্তাধিকারী মোহামেদ নুর বলেন, ২০২১ সালে কাজ শুরু করেছি। গবেষণার পর ২০২৩ সালে মিশরের বাজারে ছেড়েছি কোমল পানীয়। এর মধ্যে রপ্তানিও শুরু করে দিয়েছি। সাধারণ মানুষ আমাদের পানীয় গ্রহণ করেছে। আমরা রপ্তানিতে নির্ভরশীল হলেও মিশর আমাদের সাদরে গ্রহণ করায় স্বস্তি পেয়েছি। রপ্তানি বাজার বছর ব্যবধানে তিনশো থেকে সাড়ে তিনশো শতাংশ বেড়েছে।’
২০২৩ সালের জুলাইয়ে বাজারে আসলেও এতো অল্প সময়ে মিশরে এই পানীয়র বিক্রি বেড়েছে ৪০ শতাংশ। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, কোমল পানীয় বর্জনের এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে মানুষের অভ্যাসে পরিবর্তন আসবে, যে কারণে কোকাকোলা বা পেপসিকো কারও পক্ষেই আর বাজারে তাদের আগের অবস্থান ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। এতে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে কোম্পানিগুলো।
আবু ইসা হোল্ডিংসের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ফাওয়াজ ইদ্রিসি বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান যে অবস্থা, দুটি কারণে এটার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে পড়বে। কারণ এই বয়কট যারা করছে, তাদের বেশিরভাগই তরুণ। তাদের মনোবল অনেক শক্তিশালী । যে চিন্তাচেতনা ধারণ তারা করে আছে, সেটা এতো সহজে নষ্ট হবে না । আরেকটা কারণ, মানুষ অভ্যস্ত হয়ে যাবে। একবার অভ্যস্ত হয়ে গেলে পুরনো অভ্যাসে ফেরা কঠিন।’
শুধু কোকাকোলা, পেপসি নয়, ইসরাইলের মিত্র হিসেবে পরিচিত মার্কিন ব্র্যান্ড স্টারবাক্স, ম্যাকডোনাল্ডসও বয়কটের শিকার হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে। বিশ্বের বৃহত্তম ভোক্তা তথ্য বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠান নিলসেন আইকিউ বলছে, ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে মধ্যপ্রাচ্যে বিশ্বের বিভিন্ন নামিদামি ব্র্যান্ডের বাজারমূল্য কমে এসেছে প্রায় ৪ শতাংশ।