বিরোধীরা বলছে, সবার অধিকার নিশ্চিত করে মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করাই তাদের লক্ষ্য। তবে এই সংঘাত চলতে থাকলে মিয়ানমার ভেঙে টুকরো হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা অনেকের। এরইমধ্যে সংঘর্ষ সংঘাতে ধস নেমেছে দেশটির অর্থনীতিতেও।
১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকেই সামরিক জান্তা শাসন করছে মিয়ানমারকে। গণতন্ত্র টিকে ছিলো মাত্র কয়েক বছর। ১৯৬২ সালে জান্তা সরকার ক্ষমতা দখলের পর থেকেই বাড়তে থাকে অস্থিরতা। শুরু থেকেই সেনা শাসন, গৃহযুদ্ধ, সুশাসনের অভাব আর দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করছে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশটি। বর্তমানে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী সময়টা পার করছে মিয়ানমার। সেনা শাসনের পতনের দাবিতে দেশটিতে সরব হয়ে উঠেছে সশস্ত্র বিভিন্ন গোষ্ঠী। তাতমাদো নামে পরিচিত সেনাবাহিনী বিভিন্ন স্থানে পেরে উঠছে না জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে। সেনা অভ্যুত্থানের তিন বছরে মিয়ানমার এখন বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে।
কিন্তু কেন এই অস্থিরতা মিয়ানমারে? দেশটিতে আছে ১শ'রও বেশি জাতিগত নৃগোষ্ঠী। দুই তৃতীয়াংশ মানুষই জাতিগত বামার। যারা সরকারি আর সামরিক পর্যায়ে শক্তিশালী অবস্থানে ছিলো। কিন্তু অনেক ক্ষুদ্র গোষ্ঠী নানাভাবে নিপীড়নের শিকার হয় সামরিক বাহিনীর কাছে। অর্থনৈতিকভাবেও পিছিয়ে পড়ে গোষ্ঠীগুলো। এই ক্ষোভ থেকেই তাতমাদোর সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধতে থাকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর। এরপর শুরু হয় বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধ। ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া আর ফিলিপিন্সে আশ্রয় নেয় লাখ লাখ রোহিঙ্গা।
২০২১ সালে জেনারেল মিন অং লিয়াংয়ের নেতৃত্বে সেনা অভ্যুত্থানের আগে সীমান্তে শুরু হয় সরকারবিরোধী সংঘাত। ফেব্রুয়ারিতে জান্তা সরকার 'ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি'র নির্বাচিত গণতান্ত্রিক নেত্রী অং সান সু চিকে জোরপূর্বক ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়। এরপর তাকে আর জনসম্মখে দেখা যায় নি। বেশিরভাগ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এই সেনা শাসনের বিরোধিতা করে। এরপর পুরো দেশজুড়ে শুরু হয় বিক্ষোভ। জান্তা সরকারের প্রতি সমর্থন নেই, এমন ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগুলো ধীরে ধীরে একত্রিত হয়। কয়েকটি দল মিলে তৈরি করে 'ন্যাশনাল ইউনিটি গভার্নমেন্ট'। সেপ্টেম্বরে 'এনইউজি' যুদ্ধ ঘোষণা করে জান্তার বিরুদ্ধে, তৈরি করে সশস্ত্র সংগঠন 'পিপলস ডিফেন্স ফোর্স'।
মিয়ানমারের সাধারণ মানুষের ওপর অমানুষিক নির্যাতন করতে থাকে সেনাবাহিনী। বাড়িঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়, অনেক বিক্ষোভকারীকে আটক করা হয়, মেরে ফেলা হয় অনেক মানুষ। ২০২২ সালে এই সংঘাত আরও বড় হয়। সীমান্ত এলাকাগুলোতে জাতিগত নৃগোষ্ঠীর সংখ্যা বেশি থাকায় সেখানে সংঘাতের পরিমাণ বেশি ছিলো, তবে মান্দালয়, ইয়াঙ্গুনের মতো গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে সহিংসতা। প্রতিবেশী দেশ ভারত আর থাইল্যান্ডে পালিয়ে যান অনেক মানুষ।
এই সংঘাত সহিংসতায় ধস নামে দেশটির অর্থনীতিতে। অনেক প্রতিবেশী দেশের চেয়ে দরিদ্র মিয়ানমার। এই দেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার চীন অবকাঠামো প্রকল্প আর বিনিয়োগ নিরাপদে রাখতে সবসময় ছিলো গৃহযুদ্ধের বিরুদ্ধে। ইয়াঙ্গুনে বিনিয়োগ নিয়ে চিন্তায় পড়ে যায় চীন। সেনা অভ্যুত্থানের আগে গণতন্ত্রের সূচকে ২০২০ সালে বিশ্বের ১৭৯ টি দেশের মধ্যে মিয়ানমারের অবস্থান ছিলো ১০১ তম। ২০২২ সালে মানদণ্ডে ১৭৩ তম অবস্থানে এসেছে মিয়ানমার, যা আফগানিস্তান আর উত্তর কোরিয়ার খুব কাছে।
২০২৩ সালের অক্টোবরে সংঘবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী ব্রাদারহুড এলায়েন্স গঠন করে জান্তা সরকারকে উৎখাতে মাঠে নামে। তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি, মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর আরাকান আর্মি মিলে গঠিত জোট ৪ মাস ধরে লড়াই করে যাচ্ছে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে। চীন ও ভারতের সীমান্তবর্তী শহর ছাড়াও চিন, শান ও রাখাইন রাজ্যের অনেক শহর, এলাকা আর সেনাঘাঁটি দখল করে ফেলে অপারেশন ১০২৭' এর সদস্যরা। হাজার হাজার জান্তা সেনা আত্নসমর্পন করে। অনেকে পালিয়ে যায় ভারতে। মিয়ানমারের জান্তা সমর্থিত প্রেসিডেন্ট সেনাপ্রধান মিন্ত সোয়ে ২০২৩ সালের নভেম্বরেই আশঙ্কা প্রকাশ করেন, এই সংঘাত সহিংসতায় মিয়ানমার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে পারে। এরপরও জান্তা সরকারের দাবি, বিরোধীদের কোণঠাসা করতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেবে সেনাবাহিনী। জরুরি অবস্থার মেয়াদ হঠাৎ করেই আরও ছয় মাস বাড়িয়ে দেয় সেনাশাসিত সরকার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মিয়ানমারে গেলো ৬ দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে অনিশ্চয়তায় আছে জান্তা। নড়বড়ে অবস্থায় আর্থিক সংকটেও পড়ে গেছে দেশটির সেনাবাহিনী। অথচ এই সেনাশাসন বাস্তুচ্যুত করেছে দেশটির ২৬ লাখ মানুষকে।
