ফিরে দেখা ২০২৫: বিশ্বজুড়ে জেন-জি বিপ্লব ও তারুণ্যের উত্থান

বিশ্বজুড়ে জেন-জি বিপ্লব
বিশ্বজুড়ে জেন-জি বিপ্লব | ছবি : সংগৃহীত
0

আগুন, কাঁদানে গ্যাস, গ্রাফিতি ২০২৫ সালজুড়ে আন্দোলনে উত্তাল ছিল নেপাল থেকে মাদাগাস্কারসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। দুর্নীতি, দুর্বল শাসন আর অর্থনৈতিক অসহায়ত্বের মুখে দেশে দেশে ফুঁসে ওঠে তরুণরা। জেন-জিদের নেতৃত্বেই এ বছর সরকার পতন থেকে শুরু করে রাজনীতির পুনর্গঠন দেখেছে বিশ্ব। বৈশ্বিক ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছেও এই তরুণরাই। তবে প্রাথমিক জয়ের কাছাকাছি পৌঁছেও ঐক্য-পরিকল্পনা আর নেতৃত্বের অভাবে শেষ পর্যন্ত অধরাই থেকে গেছে দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক সম্ভাবনা।

নেপাল থেকে পেরু, মরক্কো, মাদাগাস্কার। পাপ থেকে মুক্তির প্রতীক হিসেবে খড়ের টুপিতে মাথার খুলি আর ক্রুশের হাড় হয়ে ওঠে ক্ষুব্ধ তারুণ্যের চিহ্ন। ২০২৫ সালে জেন-জি বিক্ষোভে নতমস্তিষ্ক হয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ; উৎখাত হয় দু'টি সরকারও।

১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্ম নেয়া প্রজন্ম, যাদের বয়স বর্তমানে ১৩ থেকে ২৮ বছরের মধ্যে, ঢালাওভাবে তাদেরই বলা হয় জেন-জি। বেকারত্ব, দারিদ্র আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিদায়ী বছরে বিদ্রোহী তরুণদের সাথে মিশে গেছে এই জেন-জি শব্দগুচ্ছ। দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, রাজনৈতিক আভিজাত্যের বিরুদ্ধে বিশেষ করে বছরের শেষার্ধে আন্দোলনে উত্তাল ছিল উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা থেকে শুরু করে ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়ার বিভিন্ন দেশ। জাতিসংঘের তথ্য- শুধু লাতিন আমেরিকা, এশিয়া ও আফ্রিকায় মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশেরই বয়স ২৫ বছরের নিচে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে ক্ষোভ ছড়িয়েছে রাজপথে; শাসনব্যবস্থার গভীরে পৌঁছানো ফাটল উন্মোচন থেকে শুরু করে সরকার পতন আর সংস্কারে বাধ্য করা- এভাবেই ক্ষমতার দুর্গে আঘাত হেনে তরুণরা কাপিঁয়েছে বিশ্ব।

ইন্দোনেশিয়া

বেকারত্ব বাড়তে থাকা, ব্যাপক কর্মীছাঁটাই, শিক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি, উচ্চ করসহ নানা অর্থনৈতিক সংকটের জেরে বছরের শুরুতেই ফুঁসে ওঠে ইন্দোনেশিয়ার ছাত্রজনতা। দেশের বিভিন্ন শহরে ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয়ে বিচ্ছিন্নভাবে ১০ মাসের বেশি সময় ধরে চলে আন্দোলন। আগস্টে শ্রমমন্ত্রীকে অপসারণে বাধ্য হয় দেশটির সরকার।

কেনিয়া

পূর্ব আফ্রিকার দেশ কেনিয়ায় প্রস্তাবিত অর্থ বিল আর উচ্চ করের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের জেন-জি বিক্ষোভ নতুন করে শুরু হয় চলতি বছরের জুন মাসে। পুলিশি বর্বরতা, অপহরণ আর হেফাজতে প্রাণহানির ঘটনায় ফের দানা বাঁধে ছাত্র আন্দোলন। প্রশাসনের কঠোর অবস্থান আর শক্তি প্রয়োগে বিক্ষোভ দমন হলেও, প্রশাসনের দুর্নীতি ও জবাবদিহিতার অভাব, জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয়সহ চলমান নানা অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতার কারণে জনরোষ এখনও বিদ্যমান।

আরও পড়ুন:

ফিলিপিন্স

ইন্দোনেশিয়ায় আন্দোলন চলতে থাকার মধ্যেই ফুঁসে ওঠে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার আরেক দেশ ফিলিপিন্স। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই শুরু হয় ধারাবাহিক বিক্ষোভ কর্মসূচি। বন্যা বিপর্যয় নিয়ন্ত্রণে দুর্নীতির অভিযোগে জড়িত আইনপ্রণেতা ও সরকারি কর্মকর্তাদের দ্রুত বিচারের দাবিতে আন্দোলনে যোগ দেয় সারা দেশের লাখ লাখ মানুষ। বিচ্ছিন্নভাবে আন্দোলন চলছে এখনও।

নেপাল

বছরের সবচেয়ে আলোচিত জেন-জি বিক্ষোভের সাক্ষী ছিল দক্ষিণ এশিয়ার দেশ নেপাল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিষিদ্ধের জেরে সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহজুড়ে অশান্ত ছিল হিমালয়কন্যা। দুর্নীতি, বেকারত্ব আর রাজনৈতিক স্বজনপ্রীতির অভিযোগ ঘি ঢালে আগুনে। প্রশাসনের বিক্ষোভ দমনের চেষ্টায় সহিংসতা প্রাণঘাতী হয়ে উঠলে প্রেসিডেন্টের বাসভবন-পার্লামেন্টসহ সরকারি ভবনে আগুন দেয় ক্ষুব্ধ ছাত্রজনতা। পদত্যাগে বাধ্য হন প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি; অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে পার্লামেন্ট বিলুপ্ত করে ২০২৬ সালে নির্বাচনের ঘোষণা দেন সুশীলা কার্কি।

পেরু

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ক্রমবর্ধমান অপরাধ, অর্থনৈতিক দুর্দশা, সরকারের প্রতি অনাস্থার জেরে, জবাবদিহিতা আর আগাম নির্বাচনের দাবিতে সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে, লাতিন আমেরিকার দেশ পেরুতে শুরু হয় সরকারবিরোধী বিক্ষোভ। ধারাবাহিক বিক্ষোভ ও সহিংসতার এ পর্যায়ে অক্টোবরে অভিশংসিত হন প্রেসিডেন্ট দিনা বলুয়ার্তে।

মরক্কো

দুর্নীতি আর সরকারের ব্যয় নীতির বিরুদ্ধে সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে উত্তর আফ্রিকার দেশ মরক্কো। স্বাস্থ্য-শিক্ষাসহ জনগণের মৌলিক অধিকার উপেক্ষা করে ২০৩০ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের প্রস্তুতিকে অগ্রাধিকার দেয়ায় সরকারের প্রতি ব্যাপক হতাশা থেকে এই ছাত্র-আন্দোলনের সূত্রপাত, যা চলছে প্রায় তিন মাস ধরে।

মাদাগাস্কার

তীব্র পানি ও বিদ্যুৎ সংকটের জেরে সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে বিক্ষোভ দানা বাঁধে পূর্ব আফ্রিকার দ্বীপদেশ মাদাগাস্কারে। পরবর্তীতে দুর্নীতি ও দুর্বল শাসনব্যবস্থা এবং মৌলিক অধিকার নিশ্চিতে সরকারের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে প্রবল জনমত। জনতার পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটলে জ্বালানিমন্ত্রীর অপসারণ, সরকার ভেঙে দেয়া এবং বিক্ষোভকারীদের পক্ষে সেনা অভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতায় অক্টোবরে ক্ষমতাচ্যুত, অভিশংসিত ও দেশত্যাগী হন প্রেসিডেন্ট আন্দ্রি রাজোয়েলিনা। গণআন্দোলনের জেরে সরকার পরিবর্তন হলেও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হয় মাদাগাস্কারে।

মেক্সিকো

নভেম্বরে দফায় দফায় সরকারবিরোধী আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে উত্তর আমেরিকার দেশ মেক্সিকো। মাদক পাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ায় দ্বিতীয় বৃহৎ শহর উরুপানের মেয়রকে হত্যার ঘটনায় ফুঁসে ওঠে জনতা। ক্রমবর্ধমান অপরাধ এবং দুর্নীতি দমনে ব্যর্থ প্রেসিডেন্ট ক্লডিয়া শেইনবাউমের পদত্যাগের দাবি ওঠে। মাসব্যাপী আন্দোলনে রাজধানী মেক্সিকো সিটির ন্যাশনাল প্যালেস, এমনকি দেশের সর্বোচ্চ আদালতেও হামলা চালায় বিক্ষোভকারীরা।

বুলগেরিয়া

২০২৬ সালের বাজেটে কর বৃদ্ধির পরিকল্পনার প্রতিবাদে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে বিক্ষোভ চলছে, দক্ষিণপূর্ব ইউরোপের দেশ বুলগেরিয়ায়। রাজধানী সোফিয়াসহ বিভিন্ন শহরে চলছে বিক্ষোভ। ব্যাপক দুর্নীতি আর সাধারণ জনতার স্বার্থ উপেক্ষা করে রাজনৈতিক অভিজাতদের অগ্রাধিকার দেয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলনের এক পর্যায়ে বাজেট প্রস্তাব প্রত্যাহারের পাশাপাশি, ডিসেম্বরেই পদত্যাগ করে দেশটির সরকার। তবে সুষ্ঠু নির্বাচন ও স্বাধীন বিচার বিভাগের দাবিতে এখনও রাজপথে লাখো মানুষ।

বছরের শেষে দেশে দেশে স্তিমিত হয়ে আসছে আন্দোলন। একই সাথে রাজনীতির মিশ্র পরিণতির সাক্ষী অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া তরুণরা। বিভিন্ন জেন-জি আন্দোলনে কর্মীদের মূল অংশ সংগঠিত হয়ে প্রাথমিক দাবিদাওয়া আদায় করতে পারলেও, ঐক্য-পরিকল্পনা ও নেতৃত্বের অভাবে আলোর মুখ দেখেনি কোনো নতুন রাজনৈতিক সম্ভাবনা। অনেক আন্দোলন শেষ হয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর রক্তক্ষয়ী, সহিংস নিপীড়নের মধ্য দিয়ে।

ইএ