স্থানীয় সময় বুধবার ভোররাত থেকে শুরু অভিযানের কারণ হিসেবে ইসরাইলের দাবি, আল-শিফা হাসপাতালকে নিজেদের কমান্ড সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করছিল ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস।
ইসরাইলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র জোনাথন কনরিকাস জানান, 'সরঞ্জামসহ একটা ভেস্ট, সাথে একে ফোর্টি সেভেন তো আছেই। হাতে নেবে আর অভিযান শুরু। হামাসের সশস্ত্র শাখা আল কাশেম ভেবেছিল এগুলো লুকিয়ে রাখার সেরা জায়গা হাসপাতালই।'
গেলো দু'দিনে হাসপাতালের ভেতরে রাইফেল, গ্রেনেড, সামরিক ভেস্ট, সুড়ঙ্গসহ অনেককিছুই খুঁজে পাওয়ার দাবি করেছে ইসরাইল। এসবের ভিডিও ধারণ করে তা উন্মুক্তও করে দিয়েছে বিশ্ববাসীর দেখার জন্য।
ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক সংগঠন প্যালেস্টাইনিয়ান ন্যাশনাল ইনিশিয়েটিভের প্রধান মুস্তাফা বারঘুতি বলেন, 'সুড়ঙ্গ থেকে শুরু করে যতো সামরিক যন্ত্রাংশ বা যুদ্ধাস্ত্র খুঁজে পাওয়ার দাবি করছে ইসরাইলি সেনারা, সেগুলো যে তারা নিজেরাই আল-শিফার ভেতরে ঢুকিয়ে সাজিয়ে রাখেনি, তার কী প্রমাণ?'
প্রমাণ তো নেই। বার্তা সংস্থা রয়টার্স ভিডিওতে দেখানো এলাকার অস্তিত্ব নিশ্চিত করলেও ভিডিও ধারণের সময়কাল কিংবা অস্ত্রের উৎস নিশ্চিত করতে পারেনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স এ ইসরাইলি সেনাবাহিনী আনকাট ও আনএডিটেড দাবিতে হাসপাতালের বিভিন্ন অংশের একটি ভিডিও প্রকাশ করে, যা পরে মুছে দিয়ে আরেকটি প্রায় একই রকম ভিডিও প্রকাশ করে। এতেও ইসরাইলি দাবির সত্যতা নিয়ে বয়ে যাচ্ছে প্রশ্নের ঝড়।
অভিযানের বিরোধিতা করা ঘনিষ্ঠতম যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা মিত্রদের সমর্থন ধরে রাখতে এসব ইসরাইলের সাজানো নাটক কি না, উঠছে সে প্রশ্নও। হাসপাতালে অভিযানের আপত্তি তুলেছিলেন খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। নির্বিচারে শিশুহত্যার সমালোচনা করেছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইম্যানুয়েল ম্যাখোঁ, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে ইতি টেনেছে ১০টির বেশি দেশ। সবশেষ বৃহস্পতিবার উদ্বেগ জানায় ইউরোপীয় ইউনিয়নও।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন পররাষ্ট্রীয় নীতিবিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল বলেন, 'গাজা ও এর আশপাশে যে ভয়াবহতার চিত্র আমরা দেখছি, গাজার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ না জানিয়ে পারছি না।'
যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যে ভয়াবহ আতঙ্ক ছড়িয়ে কার্যত কী উদ্ধার করছে ইসরাইলি সেনারা? সে প্রশ্নই এখন বিশ্বের দেশে দেশে। এরই মধ্যে গাজার ইন্দোনেশিয়ান হাসপাতালেও বন্ধ হয়ে গেছে চিকিৎসা কার্যক্রম। পশ্চিম তীরের জেনিনে ইবনে সিনা হাসপাতালেও চলছে ইসরাইলের সেনা অভিযান। শুধু আল-শিফা হাসপাতালেই মৃত্যুর মুখে ৬৫০ রোগী-চিকিৎসাকর্মী আর আশ্রিত সাত হাজারের বেশি বেসামরিক ফিলিস্তিনিসহ প্রায় আট হাজার মানুষ। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন, চিকিৎসা বন্ধ, নেই খাবার, পানি, নবজাতকের জন্য দুধও।
একজন ফিলিস্তিনি নারী জানান, 'আমরা ধৈর্য্য ধরছি। আমরা আল্লাহ'র প্রতি কৃতজ্ঞ। যাই ঘটুক না কেন আমাদের সাথে, আমরা আল-শিফা ছাড়ছি না। খাবার, পানি, বিদ্যুৎ কিছুই নেই। বিস্কুট আর বাদাম খেয়ে বেঁচে আছি এখন। এরপর যা মিলবে তাই খাবো। কিন্তু ধৈর্য্য ধরে যাবো।'
এদিকে, জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়ায় গাজা উপত্যকার দু'টি টেলিকম প্রতিষ্ঠানেরই কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে মোবাইল, ল্যান্ডলাইন ও ইন্টারনেট সেবার। যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার পাশাপাশি তেলের অভাবে ত্রাণবাহী ট্রাক বহরের সমন্বয় এবং ত্রাণ সরবরাহও সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ।
ইউএনআরডব্লিউএ এর কমিশনার জেনারেল ফিলিপ লাজ্জারিনি জানান, 'সমস্যা হলো, যখন জীবন বাঁচানোর কথা হয়, সেখানে কোনো শর্ত বা দরদাম চলে না। আমরা বলছি, তেল গাজায় ঢুকতে না দিলে এবার জ্বালানির অভাবে মানুষ মরতে শুরু করবে। ঠিক কখন থেকে, আমি জানি না। তবে খুব শিগগিরই এমনটা ঘটতে দেখবো আমরা।'
তেলের অভাবে গাজায় জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় পানির কূপ, পানি পরিশোধনাগার সহ অনেক সেবাই এখন বন্ধ। ২৪ হাজার লিটার ডিজেলের অভাবে থমকে রয়েছে ত্রাণ বণ্টন। হামাসের হাতে পড়লে তেল সামরিক কাজে ব্যবহার হবে, এমন দাবিতে ৭ অক্টোবরের পর থেকে উপত্যকায় তেল ঢুকতে দেয়নি ইসরাইল।