তথ্য-প্রযুক্তি
0

একই খরচে শহর ও গ্রামের ইন্টারনেট সেবায় কেনো এতো পার্থক্য

রাজধানীতে ইন্টারনেটের গতি নিয়ে কিছু গ্রাহকের অভিযোগ থাকলেও দেশের প্রান্তিক অঞ্চলে বেশিরভাগ গ্রাহকই রয়েছেন বিড়ম্বনায়। একই খরচে একই ইন্টারনেট প্যাকেজ বা ব্রডব্যান্ড সংযোগ নিয়েও শহরের তুলনায় গ্রামে সমমানের সেবা মিলছে না। যার কারণ হিসেবে ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, যন্ত্র ও প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতায় এমন পরিস্থিতি। যদিও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি বলছে, মানসম্মত সেবা নিশ্চিতে তদারকি বাড়াবে তারা।

টেকনাফ

নাফ নদী আর বঙ্গোপসাগরের কূল ঘেঁষে গড়া জনপদ, টেকনাফ। তীরে সারি, সারি নৌকা আর জেলেদের কর্মব্যস্ততা জানান দেয় জনপদের পেশা। সমুদ্রে মাছ আহরণ, বাজারজাতকরণ, শুটকি উৎপাদনে জড়িত এ উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের তাই জেনে নিতে হয় জোয়ার ভাটা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় বা আবহাওয়ার পূর্বাভাস। অনলাইন আর ইন্টারনেটের কল্যাণে এখন তথ্য মিলছে হাতের মুঠোয়।

বয়সীরা যখন আড্ডা গল্পগুজবে মগ্ন তখন এই আব্দুল শুক্কুরের মতো জেলেদের যোগাযোগ আর বিনোদন ভরসা ইন্টারনেট। তবে দেশের এ সর্বশেষ প্রান্তে, প্রান্তিক এসব মানুষের ইন্টারনেট ব্যবহারের অভিজ্ঞতা সাবলীল নয়।

শাহপরীর দ্বীপ, মিয়ানমার লাগোয়া দেশের সবশেষ ইউনিয়নের একটি। পান, সুপারি, লবণ উৎপাদন বা কৃষি এখানকার অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। তবে নিজ নিজ কাজের সাথে ইন্টারনেটের যোগসূত্র তৈরি করতে পারেন নি এখানের বাসিন্দারা।

কিন্তু লোকালয়ে ইন্টারনেটের অবস্থা কেমন? টেকনাফ সদরের মধ্যম ডেল পাড়া গ্রাম। গ্রামের বাসিন্দা আবুল হাশেম প্রতিমাসে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকার ইন্টারনেট প্যাকেজ কেনেন তিনি। তবে তার ইন্টারনেট গতি কখনো কখনো নেমে যাচ্ছে শূণ্য কেবিপিএস এ। এখানে কথা আটকে যাওয়া, ভিডিও অস্পষ্ট আর কল ড্রপ তার নিত্যদিনের ঘটনা।

একই উপজেলায় ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ যারা করেন তারাও শ্লথ গতির ইন্টারনেট কাজের প্রধান বাধা। ফলে নতুন কাজ নিতে কিংবা সময় মতো কাজ শেষ করা নিয়ে সার্বক্ষণিক দুশ্চিন্তায় থাকতে হয় ফ্রিল্যান্সার আব্দুর রহমানকে।

মোবাইল নেটওয়ার্ক দুর্বলতায় অনেকে দ্বারস্থ হয়েছেন ব্রডব্যান্ড কানেকশনে। টেকনাফে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের প্রায় তিন হাজার গ্রাহক আছে ব্রডব্রান্ডে। কিন্তু সেবার মান নিয়ে গ্রাহক অসন্তুষ্টি যেমন আছে তেমনি ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদেরও আছে হতাশা।

মানুষের সামগ্রিক যোগাযোগে যেখানে ইন্টারনেট নির্ভরতা বাড়ছে সেখানে এখনও পিছিয়ে দেশের সর্ব দক্ষিণ প্রান্তের এ জনপদ। যার প্রভাব পড়ছে এখানকার মানুষের আয় রোজগার আর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেও।

টেকনাফের অর্থনীতিতে টেলিযোগাযোগ খাতের অবদান রাখার সুযোগ থাকলেও দুর্বল অবকাঠামোর কারণে সে সুযোগ বিকশিত হয়নি। আইটি খাতের এসব দুর্বলতা সারিয়ে তোলা না গেলে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মানের স্বপ্ন কতটা সফল হবে সে প্রশ্ন রাখাই যায়।

তেতুঁলিয়া

দক্ষিণের গল্পের মতোই কি উত্তরের ইন্টারনেটের গতি? নাকি আরেকটু ভাল,স্বাচ্ছন্দ্যের? যেতে চাই মহানন্দার বয়ে যাওয়া সর্ব উত্তরের উপজেলা তেঁতুলিয়ায়। তীরবর্তী এ জনপদেও লেগেছে প্রযুক্তির বাতাস। তারুণ্যের হাতে হাতে শোভা পাওয়া মুঠোফোন ইন্টারনেটের সংযোগে করে তুলেছে প্রয়োজনের অনন্য বাস্তবতা। তাইতো প্রাকৃতিক সকল সৌন্দর্যকে উপেক্ষা করে গল্প আর আড্ডায়ও হাতের মুঠোফোনেই সবার এমন বুদ হয়ে থাকা। শুধুই কি তারুণ্য, মুঠোফোন নির্ভরতায় হার মেনেছে বয়সের সংখ্যাও।

তবে যে ইন্টারনেট অনেক কিছুকেই হাতের নাগালে এনে দিয়েছে তার সঙ্গে সম্পর্ক যেন সহজ নয়। ইন্টারনেট সেবাদাতা মুঠোফোন কোম্পানি কিংবা ব্রডব্যান্ড সংযোগদাতা, কেউ কথা রাখেনি। কখনো প্রতিশ্রুত গতি না দিয়ে, আবার কখনো এক আইপি দিয়ে ধারন ক্ষমতার অতিরিক্ত সংযোগ দিয়ে প্রতারণা করা হচ্ছে গ্রাহকের সঙ্গে। নতুন সংযোগের ফিচারে ২৫ এমবিপিএস দেয়ার কথা থাকলেও মিলছে ৭ থেকে ১০ এমবিপিএস। এছাড়া ডাউনলোড স্পিড কিংবা ফাইল ট্রান্সফারেও আছে বিড়ম্বনা।

উত্তরের জনপদ তেঁতুলিয়া কিংবা বিভাগীয় শহর রংপুর, ফ্রিল্যান্সিং আর আইটি প্রশিক্ষণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভোগান্তি যেন সবচেয়ে বেশি।

এদিকে বিবিএস এর জরিপ বলছে, ২০২০ সালে গ্রামে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর হার ছিল ৬৯ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০২৩ সালে সেটা বেড়ে হয়েছে ৭১ দশমিক ৬ শতাংশ। অর্থাৎ তিন বছরের ব্যবধানে ব্যবহারকারী বেড়েছে প্রায় দুই শতাংশ।

মূলত এইযে টেলিযোগাযোগ সেবা যার বড় অংশ জুড়ে মোবাইল কোম্পানিগুলো। যাদের মোট গ্রাহক সিমের হিসেবে আছে প্রায় ১৯ কোটি। এর মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী আছে সাড়ে ১২ কোটি। ব্যবহারকারীদের ভাষ্য, শহরে সব অপারেটরেদের নেটওয়ার্ক প্রায় সমানভাবে পাওয়া গেলেও গ্রামে সেটা পাওয়া যায় না। গ্রামে সবচেয়ে বেশি সমস্যা করে রাষ্ট্রয়াত্ত্ব অপারেটর টেলিটক। শহরে ইন্টারনেট ব্যবহার করে স্বাচ্ছন্দ্যে তারা।

টেলিকম কোম্পানিগুলো বলছে, তারা গ্রাম-শহরের সেবার মানের পার্থক্য করতে না চাইলে্ও নানা সীমাবদ্ধতায় সেটা হয়ে যায়। মূলত গ্রাহক কম ও অবকাঠামোর ব্যবহারের সুযোগ সবার সমান না থাকায় সেবা সুষম রাখতে পারেন না তারা।

অন্যদিকে ব্রডব্যান্ড সেবা নিয়ে তেমন অভিযোগ না থাকলে্ও গতি নিয়ে আছে অভিযোগ। একই সংযোগ অনেককে দেয়ায় গতি কমে। গ্রাহকরা বলছেন, ৫০০ টাকায় যে লাইনটি তারা ব্যবহার করেন তার গতির পরিমান প্রায় ৫ থেকে ৮ এমবিপিএস। আর ৮০০ কিংবা ১২০০ টাকার প্যাকেজে দেয়া হয় ৮ থেকে ২০ এমবিপিএস পর্যন্ত।

আইএসপিএবি বলছে, ঢাকায় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সুবিধা যতোটা কম খরচে দেয়া সম্ভব সেটা প্রত্যন্ত অঞ্চলে হয়না, কারণ সেখানে খরচ বেশি গ্রাহক কম।

বিটিআরসি বলছে, এই সমস্যা সমাধানে সকল অপারেটরদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সংস্থাটি এটা নিয়ে কাজ করছে বলে জানান তিনি।

এখনও ৬০ শতাংশ মোবাইল টাওয়ারে ফাইবার অপটিক্যাল সংযোগ নেই। সংযোগ বাড়ানো গেলে সমান সেবা পাবে সবাই এমনটাই মনে করেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী।

এসএসএস