মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স এবং সেবার মান সন্তোষজনক না হওয়ায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অভিযানে বন্ধ করা হয় মোহাম্মদপুরের বেসরকারি কেয়ার হাসপাতাল। আদতে কি বন্ধ নাকি চালু আছে হাসপাতালের কার্যক্রম? তাই দেখতে সেখানে যায় এখন টেলিভিশন।
হাসপাতালটিতে ঢুকতে গিয়ে সিকিউরিটি গার্ডের বাঁধার মুখে পড়তে হয়। বাঁধা পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই রিসিপশন থেকে জানানো হলো, কোনো রোগী নেই। অথচ দিব্যি রোগী বসে আছে।
কিশোরগঞ্জ থেকে গোকুল চন্দ্র বসাক তার স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন। বললেন, রিসিপশন থেকে বলা হয়েছে হাসপাতাল চালু আছে।
কেয়ার হাসপাতালের এইচ আর এডমিন মো. নুরুন্নবী বলেন, 'মেয়াদ ২০২২-২৩ পর্যন্ত ছিল। এরপরে রিনিউ হয়নি। রিনিউ করার প্রক্রিয়া চলছে।'
একই চিত্র মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারের টিজি হাসপাতাল ও ব্লাড ব্যাংকগুলোতে। বন্ধ করার পরও ভর্তি আছে রোগী, চলছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা কার্যক্রম। সংরক্ষণ করা হচ্ছে বিভিন্ন গ্রুপের রক্ত। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা জানালেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এখন অব্দি কোন চিঠিপত্র পাননি। তারা জানেনই না তাদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে। তবে বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে ক্লিনিক বন্ধের ঘোষণা দেখেছেন।
টিজি হাসপাতালের রিসিপসনিস্ট সাইফুল ইসলাম বলেন, 'পেশেন্ট যারা ছিল তাদেরকে রিলিজ করে দিয়েছি নতুন কোন পেশেন্ট ভর্তি করা হয়নি।'
রেডিয়াম ব্লাড ব্যাংকের পরিচালক শাখাওয়াত হোসেন দুলাল বলেন, 'নোটিশ কি দেওয়া হয়েছিল? অনলাইন পত্রিকায় আমরা দেখতেছি কিন্তু স্যার তো আমাদের এখানে সবকিছু ঠিক পেয়েছে শুধু ডাস্টবিন ছিল না।'
ল্যাব কনসালটেন্ট বলেন, 'আমাদের কাছে এখনো চিঠি বা এমন কিছু আসেনি যার কারণে আমরা এখনো কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।'
অভিযানে বন্ধ করা এ ধরনের হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ব্লাড ব্যাংকগুলোতে কার্যক্রম এখনো চলছে। তারা বলছেন বন্ধের কোন নথি এখনো তাদের কাছে পৌঁছায়নি।
বন্ধ করে দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোতে কার্যক্রম চালানো বেআইনি উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, চিঠি পায়নি বলে কেউ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চালু রাখতে পারে না। উপ-পরিচালক ডা. শেখ দাউদ আদনান বলেন, চিঠি পেয়েছে কি পায় নি সেটা ব্যাপার না। তাদেরকে চিঠি ইস্যু করা হয়েছে। তারা এটা হাতে পায় আর না না পায়, এটা অফিসিয়াল অর্ডার।
প্রতি বছরই এরকম অভিযান পরিচালনা করা হলেও হয়নি বিশেষ কোন পরিবর্তন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতীকী অর্থে এ অভিযান গুরুত্বপূর্ণ হলেও দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের জন্য প্রচলিত দণ্ডবিধি আইনে ভোক্তাদের সুরক্ষিত করা সম্ভব নয়। দরকার আইনের সংস্কার এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও সংস্থার সঠিক সমন্বয়।
চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলি বলেন, 'প্রাইভেট সেক্টরে স্পেশাল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার জন্য যেসকল আইন বাস্তবায়ন করা দরকার সেটা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে করতে হবে। তাহলে দীর্ঘমেয়াদী সমাধান হবে। শুধু ঝটিকা অভিযান করলে স্থায়ী সমাধান আসবে না।'
বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যথাযথ সেবা নিশ্চিত করতে প্রবেশপথে লাইসেন্স টানানো, তথ্য কর্মকর্তা নিয়োগ ও লেবার রুম প্রটোকল মানতে বাধ্যবাধকতাসহ ১০ দফা নির্দেশনা দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
সেই নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা, সে বিষয়ে তদারকি করতে সম্প্রতি রাজধানীসহ সারাদেশে বিভিন্ন ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কার্যক্রম পরিদর্শনসহ অভিযান পরিচালনা করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আর এতে উঠে আসে নানান অসঙ্গতির চিত্র।
এসব ক্লিনিকে অনুমোদনের বাইরে শয্যা বাড়ানো হয় ইচ্ছামতো, ল্যাব কনসালটেন্টের স্বাক্ষর ছাড়াই দেয়া হয় রিপোর্ট, ব্লাড ব্যাংক আর নমুনা সংগ্রহে ধরা পরে মারাত্মক অনিয়ম। এসব অনিয়মের তথ্য লিপিবদ্ধ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
কয়েকদিনের অভিযানে রাজধানীতে এখন পর্যন্ত ২২টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ব্লাড ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এরমধ্যে একটিতে আইসিইউ বন্ধসহ কারণ দর্শানোর নোটিশ, ৬টি ক্লিনিককে শোকজ, ৩ টি সাময়িক বন্ধ, ১১টি স্থায়ীভাবে বন্ধ ও এন্ডোস্কোপি করাতে গিয়ে রোগীর মৃত্যু হওয়ায় একটিতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
নতুন দায়িত্ব নিয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে বেশ নড়েচড়ে বসেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন। সাফ জানিয়েছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কোন দুর্নীতি ও অনিয়ম সহ্য করা হবে না। প্রধানমন্ত্রীও এ বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি দেখাতে বলেছেন। এখন দেখার বিষয় কতটুকু বদল হয় স্বাস্থ্যখাতের চিত্র ?