গণতন্ত্রের অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ার এই গণভোট কী এবং একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশে এই পদ্ধতি কতবার ব্যবহৃত হয়েছে, চলুন জেনে নিই গণভোটের ইতিহাস।
গণভোট কী এবং গণতন্ত্রে এর গুরুত্ব (What is Referendum & Importance)
গণভোট হলো জনগণের অংশগ্রহণে একটি সরাসরি ভোট প্রক্রিয়া। যেখানে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য দেশের সব যোগ্য ভোটারের (All eligible voters) মতামত সরাসরি ভোট বাক্সের মাধ্যমে চাওয়া হয়। এটি মূলত কোনো সাংবিধানিক পরিবর্তন (Constitutional Amendment), বড় নীতিগত সিদ্ধান্ত, বা সরকারের জনসমর্থন যাচাইয়ের জন্য ব্যবহৃত হয়।
আরও পড়ুন:
গণভোটের মাধ্যমে জনগণের প্রত্যক্ষ মতামত প্রতিফলিত হয়, যা একটি গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য অপরিহার্য। গণভোটকে গণতন্ত্রের একটি বিশুদ্ধ রূপ বলা যেতে পারে। কারণ এখানে জনগণ তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে নয়, বরং সরাসরি নিজেদের সিদ্ধান্ত জানায়।
গণভোটের মূল উদ্দেশ্য:
জনসমর্থন যাচাই: কোনো নতুন শাসনব্যবস্থা বা বড় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রতি জনসমর্থন নিশ্চিত করা।
সাংবিধানিক পরিবর্তন: সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী বা পরিবর্তন কার্যকর করার আগে জনগণের অনুমোদন নেয়া।
কর্তৃত্ব নিশ্চিত করা: রাজনৈতিক নেতৃত্বের কর্তৃত্ব ও বৈধতা জনগণের ভোটের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা।
গণভোট (Referendum) এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে জনগণ কোনো নির্দিষ্ট প্রস্তাব, আইন বা নীতিগত বিষয়ে সরাসরি ভোটদানের মাধ্যমে তাদের মতামত প্রকাশ করে থাকে। এর মাধ্যমে সরকার বা সংসদ নয়, জনগণই সরাসরি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ পায়। বাংলাদেশে সাধারণত ‘গণভোট আইন, ১৯৯১’ এবং সংশ্লিষ্ট বিধি দ্বারা এ প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়।
গণভোটের মূল প্রক্রিয়া (Steps of a Referendum)
গণভোটের প্রক্রিয়া মূলত জাতীয় নির্বাচনের মতোই হয়ে থাকে, তবে ভোটদানের বিষয়বস্তু কিছুটা ভিন্ন হয়ে থাকে। নিচে গণভোটের মূল ধাপগুলো উল্লেখ করা হলো:
১. আইনি ভিত্তি তৈরি
সিদ্ধান্ত গ্রহণ: প্রথমে সরকার বা সংসদের পক্ষ থেকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে (যেমন: সংবিধান সংশোধন বা নতুন আইন) জনগণের মতামত নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
আরও পড়ুন:
আইন প্রণয়ন বা নির্দেশ জারি: সেই অনুযায়ী গণভোট অনুষ্ঠানের জন্য একটি আইন বা আদেশ জারি করা হয়। (যেমন, বর্তমান ক্ষেত্রে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’ জারি করা হয়েছে)।
২. প্রশ্ন নির্ধারণ ও প্রচার
প্রশ্ন তৈরি: ব্যালট পেপারে যে বিষয়ে জনগণের মতামত চাওয়া হবে, সেই নির্দিষ্ট প্রশ্ন বা প্রশ্নমালা তৈরি করা হয়। প্রশ্নটি সাধারণত এমন হয়, যার উত্তরে ভোটাররা কেবল ‘হ্যাঁ’ (পক্ষে) অথবা ‘না’ (বিপক্ষে) ভোট দিতে পারে।
উদাহরণ: ‘‘[প্রস্তাবিত বিল বা সংস্কার] বিষয়ে রাষ্ট্রপতি সম্মতি দেবেন কি দেবেন না?’’
প্রচারণা: রাজনৈতিক দল ও পক্ষগুলো নিজেদের পছন্দের ফলাফলের পক্ষে ব্যাপক প্রচারণা চালায়।
৩. নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি
প্রজ্ঞাপন জারি: নির্বাচন কমিশন (Election Commission) সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন জারি করে গণভোটের তারিখ ঘোষণা করে।
কর্মকর্তা নিয়োগ: নির্বাচনের মতোই প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার এবং পোলিং অফিসার নিয়োগ করা হয়।
ব্যালট ছাপানো: নির্দিষ্ট প্রশ্নসহ ব্যালট পেপার ছাপানো হয়।
৪. ভোটদান প্রক্রিয়া
ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতি: ভোটাররা জাতীয় ভোটার তালিকায় নাম থাকা সাপেক্ষে নির্ধারিত ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হন।
ভোটদান: ভোটার ব্যালট পেপার নিয়ে ভোটদানের গোপন কক্ষে যান। সেখানে তিনি নির্দিষ্ট প্রতীক বা চিহ্নের ওপর সীলমোহর মেরে তার পছন্দের মতামত জানান—হয় ‘হ্যাঁ’ (পক্ষে) অথবা ‘না’ (বিপক্ষে)।
ভোটবাক্সে প্রবেশ: ভোট দেয়া শেষে ব্যালট পেপার ভাঁজ করে নির্ধারিত ব্যালট বাক্সে প্রবেশ করানো হয়।
৫. ফলাফল ঘোষণা
গণনা: ভোটদান শেষে প্রিজাইডিং অফিসারদের তত্ত্বাবধানে ভোট গণনা করা হয়।
ফলাফল: গণনা শেষে রিটার্নিং অফিসার কর্তৃক চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করা হয়।
বাধ্যবাধকতা: গণভোটের ফলাফল সাধারণত আইনত বাধ্যতামূলক হয়। যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট (মোট ভোটের অধিকাংশ) 'হ্যাঁ' এর পক্ষে যায়, তবে প্রস্তাবটি গৃহীত হয় এবং সে অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়। আর যদি 'না' এর পক্ষে যায়, তবে প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়।
বর্তমান প্রেক্ষাপট: দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা করেছেন যে, এবারের গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একই দিনে অনুষ্ঠিত হবে।
এক্ষেত্রে ভোটারদের একই দিনে নির্বাচনের পাশাপাশি সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবিত ‘জুলাই সনদ’ নিয়েও ভোট দিতে হবে।
বাংলাদেশে কতবার গণভোটের ব্যবহার হয়েছে? (How many times have referendums been used in Bangladesh?)
স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে মোট তিনবার গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে দুটি ছিল প্রশাসনিক এবং একটি সাংবিধানিক গণভোট।
প্রথম গণভোট হয়েছিল প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৭ সালে। দ্বিতীয় গণভোট হয় রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৫ সালে। সবশেষ গণভোট ১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম গণভোট
বাংলাদেশে প্রথম গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭৭ সালের ৩০ মে, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনকাজের বৈধতা যাচাইয়ের জন্য। ভোটের মাধ্যমে দেশের জনগণ জানান, রাষ্ট্রপতি এবং তার নীতি ও কর্মসূচির প্রতি তারা আস্থা রাখেন কি না। সরকারী ঘোষণা অনুযায়ী, ঐ গণভোটে মোট ভোটারের মধ্যে ৮৮ দশমিক ১ শতাংশ ভোটদান করেন। এর মধ্যে ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়ে ৯৮ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ‘না’ ভোট পড়ে ১ দশমিক ১ শতাংশ।
বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় গণভোট
দ্বিতীয় গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের নীতি ও কর্মসূচির বৈধতা যাচাইয়ের জন্য ছিল এই গণভোট। আস্থা থাকলে জেনারেল এরশাদের ছবিসহ 'হ্যাঁ' বাক্সে এবং আস্থা না থাকলে 'না' বাক্সে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। নির্বাচনী কমিশনের তথ্যানুযায়ী, ঐ গণভোটে মোট ভোটগ্রহণের হার ছিল ৭২ দশমিক ২ শতাংশ। এর মধ্যে ‘হ্যাঁ’ ভোট ছিল ৯৪ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ‘না’ ভোট ছিল ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।
বাংলাদেশের ইতিহাসে তৃতীয় গণভোট
গণআন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। এরপর পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয় বিএনপি। ১৬ বছরের রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসন থেকে প্রধানমন্ত্রীশাসিত সংসদীয় পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট সংসদে বিল পাস হয়। দেশের ইতিহাসে অনুষ্ঠিত সেই তৃতীয় গণভোটে মোট ভোট পড়েছিল ৩৫ দশমিক ২ শতাংশ।
এর মধ্যে, ১ কোটি ৮৩ লাখ ৮ হাজার ৩৭৭ জন ভোটার সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে ভোট দেন, যা হার ৮৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। অন্যদিকে, ৩৩ লাখ ৯০ হাজার ৬২ জন ভোটার ‘না’ ভোট দেন, অর্থাৎ তাঁরা রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসনব্যবস্থার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। ‘না’ ভোটের হার ছিল ১৫ দশমিক ৬২ শতাংশ। এই গণভোটে ৯৯ দশমিক ১৩ শতাংশ ভোট বৈধ ছিল, যেখানে বাতিল হয়েছিল শূন্য দশমিক ৮৭ শতাংশ ভোট।
আরও পড়ুন:
তারিখ উদ্দেশ্য ফলাফল ১৯৭৭ সাল (৩০ মে) প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রতি আস্থা যাচাই: সামরিক শাসন প্রত্যাহারের পর তার শাসন ব্যবস্থার প্রতি জনগণের সমর্থন নিশ্চিত করা। সরকারি ফলাফল অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট জিয়ার প্রতি বিপুল জনসমর্থন ছিল। ১৯৮৫ সাল (২১ মার্চ) প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের প্রতি আস্থা যাচাই: দেশের প্রশাসনিক সংস্কার এবং এরশাদের গৃহীত পদক্ষেপগুলোর প্রতি জনসমর্থন চাওয়া। এরশাদের পক্ষে রায় আসে, কিন্তু নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ ছিল। ১৯৯১ সাল (১৫ সেপ্টেম্বর) ১২তম সংশোধনী কার্যকর করা: দেশে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি (Parliamentary System) পুনঃপ্রবর্তন করা হবে কিনা, সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া। বিপুল ভোটে সংসদীয় পদ্ধতির পক্ষে রায় আসে। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক গণভোট।
গণভোটের বিধান বাতিল: বর্তমান সাংবিধানিক অবস্থান (Abolition of Referendum)
বাংলাদেশের সংবিধান থেকে গণভোটের বিধানটি এখন আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল করা হয়েছে। ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর (15th Amendment) মাধ্যমে গণভোটের বিধানটি বাতিল করা হয়।
সংশোধনীর মূল কারণ ছিল, পূর্বের সামরিক শাসকদের দ্বারা নিজেদের ক্ষমতা বৈধ করার জন্য গণভোটের অপব্যবহার। সরকার মনে করে, গণভোটের বিধানটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য একটি ঝুঁকি তৈরি করেছিল।
আরও পড়ুন:
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই অনুষ্ঠিত হবে গণভোট। বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন দেশে গণভোট আয়োজিত হবে। এতে সংস্কারের লক্ষ্য কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত হবে না।
তিনি বলেন, ‘আমরা সকল বিষয় বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোটের আয়োজন করা হবে। অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচনের মতো গণভোটও ফেব্রুয়ারির প্রথমার্থে একইদিনে অনুষ্ঠিত হবে। এতে সংস্কারের লক্ষ্য কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত হবে না। নির্বাচন আরও উৎসবমুখর ও সাশ্রয়ী হবে। গণভোট অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে উপযুক্ত সময়ে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করা হবে।’
গণভোটে যে চার প্রশ্ন থাকবে
প্রশ্নটি হবে এরকম: ‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং জুলাই জাতীয় সনদে লিপিবদ্ধ সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলোর প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করছেন?’
ক) নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ার আলোকে গঠন করা হবে।
খ) আগামী সংসদ হবে দুই কক্ষ বিশিষ্ট। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ জন সদস্য বিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন দরকার হবে।
গ) সংসদে নারীর প্রতিনিধি বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্থানীয় সরকার-সহ বিভিন্ন বিষয়ে যে ৩০টি প্রস্তাবে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমত হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলো বাধ্য থাকবে।
ঘ) জুলাই সনদে বর্ণিত অন্যান্য সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়ন করা হবে।
গণভোটের দিন এই চারটি বিষয়ের ওপর একটিমাত্র প্রশ্নে আপনি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দিয়ে আপনার মতামত জানাবেন।
বৈশ্বিক গণভোট: ইতিহাস ও উদাহরণ
ফ্রান্স: গণভোটের সূচনা
১৭৯৩ সালে ফ্রান্সে প্রথমবারের মতো গণভোটের আয়োজন করা হয়। মন্টানিয়ার্ড সংবিধান অনুমোদনের জন্য এই ভোট অনুষ্ঠিত হয়। ফ্রান্সে 'প্লেবিসাইট' নামে পরিচিত এই পদ্ধতি আধুনিক গণভোটের ভিত্তি তৈরি করে।
সুইজারল্যান্ড: প্রাতিষ্ঠানিক গণভোটের জন্মভূমি
১৮০২ সালে সুইজারল্যান্ডে আংশিক গণভোটের সূচনা হয়। ১৮৪৮ সালে নতুন সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর গণভোটকে স্থায়ী ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়। বর্তমানে সুইস নাগরিকরা নিয়মিতভাবে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন।
নরওয়ে: গণভোটে অর্জিত স্বাধীনতা
১৯০৫ সালের গণভোটে নরওয়ের জনগণ সুইডেন থেকে স্বাধীনতার পক্ষে রায় দেন। এই গণভোট ইউরোপের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল গণভোটগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে স্বীকৃত।
যুক্তরাজ্য: ব্রেক্সিট গণভোট
২০১৬ সালের ব্রেক্সিট গণভোটে যুক্তরাজ্যের জনগণ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগের পক্ষে ভোট দেন। ২০২০ সালের ৩১ জানুয়ারি যুক্তরাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে ইইউ ত্যাগ করে।
তুরস্ক: সাতটি গণভোটের দেশ
১৯৬১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তুরস্কে সাতটি জাতীয় গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৭ সালের গণভোট ছিল সবচেয়ে বিতর্কিত, যেখানে সংসদীয় ব্যবস্থার বদলে প্রেসিডেন্সিয়াল শাসনব্যবস্থা চালু হয়।
চিলি: গণভোটের মাধ্যমে রাজনৈতিক রূপান্তর
চিলিতে তিনটি ঐতিহাসিক গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে:
ক. ১৯৮৮: পিনোশের শাসনের অবসান
খ. ২০২০: নতুন সংবিধান প্রণয়নের অনুমোদন
গ. ২০২২: নতুন সংবিধান প্রস্তাব বাতিল
গণভোট (Referendum) সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তর নিচে দেয়া হলো:
প্রশ্ন : গণভোট কী?
উত্তর : গণভোট হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে কোনো নির্দিষ্ট আইন, সাংবিধানিক পরিবর্তন বা নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়ে দেশের সকল যোগ্য ভোটারের মতামত সরাসরি ভোটের মাধ্যমে চাওয়া হয়।
আরও পড়ুন:
প্রশ্ন :বাংলাদেশে এখন কি গণভোট করা সম্ভব?
উত্তর : না, ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে গণভোটের বিধান বাতিল করায় বর্তমানে বাংলাদেশে কোনো বিষয়ে গণভোট করা সম্ভব নয়।
প্রশ্ন :বাংলাদেশের ইতিহাসে মোট কতবার গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে?
উত্তর : বাংলাদেশের ইতিহাসে মোট তিনবার (১৯৭৭, ১৯৮৫ এবং ১৯৯১) গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে।
প্রশ্ন :বাংলাদেশে সর্বশেষ কবে গণভোট হয়েছিল?
উত্তর : বাংলাদেশে সর্বশেষ গণভোট হয়েছিল ১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
প্রশ্ন :বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গণভোট কোনটি ছিল?
উত্তর : ১৯৯১ সালের গণভোট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ এর মাধ্যমে দেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তন করা হয়।
প্রশ্ন : গণভোট এবং সাধারণ নির্বাচন এর মধ্যে মূল পার্থক্য কী?
উত্তর : সাধারণ নির্বাচন হলো জনগণের প্রতিনিধি বাছাই করা। আর গণভোট হলো কোনো নীতি বা সাংবিধানিক প্রশ্নে জনগণের মতামত সরাসরি 'হ্যাঁ' বা 'না' ভোটে নেওয়া।
প্রশ্ন : গণভোটের বিধান বাতিল করা হয় কোন সালে?
উত্তর : গণভোটের বিধানটি ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিল করা হয়।
প্রশ্ন : কেন গণভোটের বিধান বাতিল করা হয়েছিল?
উত্তর : মূলত পূর্ববর্তী সামরিক শাসকদের দ্বারা নিজেদের ক্ষমতা বৈধ করার জন্য গণভোটের অপব্যবহার রোধ করার জন্য এই বিধান বাতিল করা হয়।
প্রশ্ন : প্রথম গণভোট কোন প্রেসিডেন্টের আমলে হয়েছিল?
উত্তর : বাংলাদেশের প্রথম গণভোট ১৯৭৭ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রতি আস্থা যাচাইয়ের জন্য অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
প্রশ্ন : গণভোটের মাধ্যমে জনগণ কী ধরনের মতামত দেয়?
উত্তর : গণভোটে জনগণ সাধারণত কোনো প্রস্তাব বা নীতির পক্ষে (হ্যাঁ) অথবা বিপক্ষে (না) এই দুটি মতের মধ্যে একটি বেছে নেয়।




