শিক্ষা
0

শহরের চেয়ে এগিয়ে গ্রামের প্রাথমিক স্কুল

সময়ের সঙ্গে দেশের প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষাদান প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আসলেও তার কমই ছোঁয়া লেগেছে রাজধানীর সরকারি স্কুলে। অনেক ক্ষেত্রেই গ্রাম অঞ্চলের চেয়েও পিছিয়ে এসব প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো। তৃণমূল পর্যায়ে যেখানে খোলা মাঠে ও বহুতল ভবনের কক্ষে বসে শিশুরা শিখছে, সেখানে রাজধানীতে মাঠ তো দুরের কথা একটি মাত্র কক্ষেই সব শ্রেণির শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেখা যায়।

সবুজ ঘেরা পরিবেশের সঙ্গে বিশাল মাঠ নিয়ে দাঁড়িয়ে বিদ্যালয় ভবন। তাই এখানকার পড়াশোনাটাও যেন হয় খোলামনে।শ্রেণিকক্ষে বই-খাতার ব্যাগ রেখেই মাঠে নেমে পড়া। ক্লাসের বিরতি কিংবা শেষে খেলাধুলা বা হইহুল্লোর। এসবই ছোট্ট শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য আর মনের খোরাক।

ক্লাস শুরুর আগে নিয়ম মেনে সবাবকে হাজির থাকতে হয় পিটিতে। যেখানে শারীরিক চর্চার পাশাপাশি ফুটে ওঠে সম্প্রীতির চিরাচরিত রূপ। এর সঙ্গে অবকাঠামোগতসহ বিভিন্ন বদল ও আধুনিকায়নে অনেকটাই বদলে গেছে এখানের শিক্ষা দেয়ার পরিবেশ।

শিক্ষার্থীরা বলেন, 'স্কুলে অনেক উৎসব পালন করি। আমাদের ম্যাডামরা অনেক সুন্দরভাবে পড়ালেখা করান।'

আরেকজন বলেন, 'কোরআন তেলাওয়াত করি, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয়, খেলাধুলা করি।'

গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকারা বলছেন, কয়েক বছরে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে বেড়েছে শিক্ষার গুণগত মান।

শিক্ষকরা বলেন, 'শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। সবকিছুর উন্নয়ন হয়েছে এবং আমরা সার্বিকভাবে পাঠদান করাতে পারছি।'

আরেকজন বলেন, 'আমাদের ভবনগুলো এখন খুব উন্নতমানের। সবসময় রয়েছে বিদ্যুতের ব্যবস্থা।'

অভিভাবকরা বলেন, 'আমরা যখন লেখাপড়া করেছিলাম, তখন তো এত উন্নত ছিল না।'

আরেকজন বলেন, 'আমাদের ছেলে মেয়েরা ভালোভাবে লেখাপড়া করতে পারতেছে, এতে আমরা অভিভাবকরা খুশি।'

আগের মত জরাজীর্ণ-ভঙ্গুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কমই দেখা যায়। বরং, এখন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও নজরে আসে বহুতল ভবনের সরকারি পাঠশালা।

বিশুদ্ধ বাতাস আর প্রকৃতির সান্নিধ্যে বড় হয়ে উঠছে গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এক সময় প্রাইমারি স্কুল বলে নাক সিটকানো শহুরে নাগরিকদের তিরস্কার মিটছে এমন বহুতল ভবনে। পাঠদান কক্ষের নিরাপত্তার সঙ্গে বেড়েছে মানসম্পন্ন শিক্ষাও। দেশের গ্রামাঞ্চলের শিক্ষা ব্যবস্থা যখন এগিয়েছে কয়েক ধাপ। সেখানে খোদ রাজধানীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষাচিত্র বর্তমানে কেমন, সেটা দেখা যেতে পারে।

রাজধানীর অন্যতম অভিজাত এলাকা ওয়ারীর লাল মোহন সাহা স্ট্রীটের মুসলিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। জীর্ণতার ছাপই জানান দিচ্ছে এখানকার শিক্ষার পরিবেশের অবস্থা।

এ বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী বলেন, 'এক বেঞ্চে তিনজন চারজন বসতে গেলে আমাদের কষ্ট হয়।'

আরেকজন বলেন, 'যেখানে বসি সেখানে একটা ওয়াশরুম আছে, সেখানে অনেক ভিড়া-ভিড়ি হয়।'

প্রতিষ্ঠানটি একজন শিক্ষক বলেন, 'আমরা খুব আতঙ্কে আছি, কখন যে বিল্ডিংটা ধ্বসে পড়ে। কখন যে তাদের মাথার ওপর ছাদটা খুলে পড়ে।'

টিনের ছাউনি ও পাকা দেয়াল ঘেরা মোটামুটি ৫শ' বর্গফুট আয়তনের এক কক্ষের বিদ্যালয়ে একই সময়ে চলে একাধিক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পাঠদান। বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষিকাসহ শিক্ষিকদের বসার স্থান, দাপ্তরিক কাজ সবই চলে একটি কক্ষে।

শিক্ষকরা বলেন, 'মেয়র আশ্বাস দিয়েছেন আবার সরকারিভাবেও আশ্বাস দিয়েছে, কিন্তু কাজ হচ্ছে না। এই না হওয়ার কারণে ক্লাস নিতে শিক্ষকদেরও হিমশিম খেতে হয়।'

আরেকজন বলেন, 'এখানে এসে তাকালেই তো ভয় কাজ করে। তারপরে ওয়াশরুম দেখা যায়। বাচ্চাদের পানি খাওয়ার ফিল্টারের ব্যবস্থা নেই। '

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, রাজধানীতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৩৪২টি, যার মধ্যে ত্রিশটির বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুরবস্থার চিত্র স্পষ্ট। এসব বিদ্যালয়গুলো অধিকাংশের মূল সমস্যাই জমি ও অবকাঠামো বেদখল। ঢাকার দুই সিটিতে বিদ্যালয়গুলোর অবস্থান নিয়েও জটিলতা রয়েছে। আর বর্তমানে দৃষ্টিনন্দন করতে প্রকল্পের আওতায় ৪০টি বিদ্যালয়ের কাজ চলমান রয়েছে। যেখানে গুলশানে ১১টি, মিরপুরে ৮টি, মোহাম্মদপুর আর সেনানিবাস থানায় ৪টি করে, ডেমরায় ৩টি, মতিঝিল-সূত্রাপুর-লালবাগ ও রমনায় ২টি করে বিদ্যালয়ের কাজ চলছে। এছাড়া ১টি করে রয়েছে তেজগাঁও ও কোতোয়ালী এলাকায়।

শিক্ষার্থীরা বলেন, 'আমাদের পিটি করতে সমস্যা। আমাদের খেলা করার সমস্যা। আমাদের মাঠ নেই।'

আরেকজন বলেন, 'খেলাধুলা করতে গেলে পড়ে যায় হাত-পা ছুলে যায়। যদি একটা মাঠ থাকতো তাহলে ভালো হত।'

পিছিয়ে পড়া রাজধানীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর পরিবেশ ও শিক্ষাদানের পরিস্থিতি অনেকটাই নাজুক। যেখানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশ নিশ্চিত করতেও হিমশিম খেতে হয়। এ কারণে এসব স্কুলে নিজেদের সন্তানদের ভর্তির আগ্রহও কম অভিভাবকদের।

অভিভাবকরা বলেন, 'ঢাকার শহরে এত মাঠও নেই। খালি জায়গাও নেই। যে কারণে আমরা সন্তানদের ভর্তি করতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছি।'

আরেকজন বলেন, 'খেলাধুলা করতে পারলে তাদের পড়ালেখাও ভালো হবে শরীর সুস্থ থাকবে। অভিভাবকরা শান্তিতে থাকবে।'

শতভাগ প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ওপর জোর দিচ্ছেন বিশিষ্টজনরা। তাদের মতে, শিক্ষাব্যবস্থার মূল অন্তরায় হচ্ছে বৈষম্য।

শিক্ষাবিদ ড. মনজুর আহমেদ বলেন, 'এখন লটারি করে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে। কিছু বিদ্যালয়ে তারা যেতে চাই। অন্যগুলো তারা যেতে চাই না, কারণ তাদের মান ভালো না। প্রতিটা এলাকা জুড়ে পরিকল্পনা করতে হবে এখন কী আছে আর কী প্রয়োজন। সেই প্রয়োজনটা আমরা একবারে মেটাতে পারব না। সেইটা পাঁচ বছরে করে করে মেটানোর পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে।'

এদিকে দেশের সরকারিসহ সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দায়িত্বে থাকা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলছেন, সমান দৃষ্টিতেই সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য কাজ করে সরকার। তার দাবি, রাজধানীকে গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, 'আশা করছি, আগামী এক দুইবছর পর ঢাকা মহানগরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পুরো অবকাঠামো চেঞ্জ হবে। কিছু আছে যেখানে জটিলতা আছে, মামলা আছে  সেখানে। দুই চারটায় হয়তো পিছিয়ে যাব কিন্তু আমাদের যে লক্ষ্য সেটা আমরা পূরণ করতে পারব।'

প্রান্ত থেকে কেন্দ্রে শিক্ষার বৈষম্য কমাতে জরুরি উদ্যোগের তাগিদ অভিভাবক থেকে শিক্ষাবিদসহ সবার। তারা বলছেন, সৃজনশীল পাঠ্যক্রমে শিশু তার শৈশবকে আক্ষরিক অর্থে সাতরঙে রাঙিয়ে বেড়ে উঠুক নিজ মেধায়।

ইএ