পরিষেবা
অর্থনীতি
বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ের নামে বাড়লে ভোক্তার চাপ বাড়বে
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মেনে বছরে চারবার বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ের নামে বাড়ালে ভোক্তার ওপর চাপ বাড়বে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ভর্তুকি কমাতে দাম বাড়ানো নয়, বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমাতে হবে। একইসঙ্গে সব শ্রেণির গ্রাহকের জন্য বিদ্যুতের দাম বাড়ানো যৌক্তিক নয় বলেও মনে করেন তারা।

দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৭ হাজার মেগাওয়াট। স্বাভাবিক সময়ে চাহিদা ১৫ হাজার মেগাওয়াটের আশপাশে থাকলেও গড় উৎপাদন ১৩ হাজার মেগাওয়াট। তীব্র গরমে এই চাহিদা পৌঁছেছে ১৮ হাজার মেগাওয়াটে।

বিদ্যুতের সক্ষমতা এবং উৎপাদন যত বাড়ানো হচ্ছে সেই সঙ্গে এর খরচ বাড়ছে। উৎপাদন ব্যয় থেকে কম মূল্যে ভোক্তা পর্যায়ে বিতরণ করা হচ্ছে। ফলে প্রতি অর্থবছরে হাজার হাজার কোটি টাকা এ খাতে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে‌ সরকারকে।

অর্থ মন্ত্রণালয় ও পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি হিসেবে বাজেটে বরাদ্দ ছিল ৫০ হাজার ২৩৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা। যদিও পরে সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৩৯ হাজার ৪০৬ কোটি ৭৯ লাখ টাকা করা হয়। মূলত ভর্তুকির বিপরীতে বিদ্যুতে বিশেষ বন্ড ইস্যুর কারণে তা অনেকটা কমেছে। এখন পর্যন্ত বিদ্যুতে মোট ১৬ হাজার কোটি টাকার বিশেষ বন্ড ইস্যু করা হয়েছে। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরেও বিদ্যুতে ভর্তুকি দেয়া হয় ৩৯ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকার বেশি।

আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচির শর্তে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে পুরোপুরি ভর্তুকি বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত মার্চ মাসে বিদ্যুতের দাম বাড়ায় সরকার। সবশেষ এপ্রিলে বাংলাদেশে সফররত আইএমএফের প্রতিনিধি দলকে জানানো হয়, আগামী তিন বছরে ১২ ধাপে এই খাতের সব ভর্তুকি তুলে নেয়া হবে‌।

তথ্য মতে, ২০২২-২৩ অর্থবছর দেশে নিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ আমদানিসহ ছিল ৮ হাজার ৭০৩ কোটি ৯৭ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হয়েছে ৯৬ হাজার ৮৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় পড়ে ১১ টাকা চার পয়সা। যদিও গত অর্থবছর প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় বিক্রয় মূল্য দাঁড়ায় পাঁচ টাকা ৯৪ পয়সা। এতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতে লোকসান গুণতে হয় পাঁচ টাকা ১০ পয়সা।

বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন করুক বা না করুক চুক্তি অনুযায়ী প্রতিটি কেন্দ্রকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়। গত বছর ৪১ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা অলস বসে ছিল। সেই সঙ্গে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি শূন্যে নামাতে বাল্ক মূল্যহার ছয় টাকা ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১২ টাকা ১১ পয়সা করার পরামর্শ দেয় এ খাতের সংস্থাগুলো। এর সঙ্গে বিতরণ লস, কোম্পানিগুলোর পরিচালন খরচসহ অন্যান্য ব্যয় যুক্ত করলে খুচরা মূল্যহার গড়ে ১৪ টাকা ৬৮ পয়সা করার বিষয়ে বলা হয়। এতে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্যহার গড়ে ৬ টাকা ৪৩ পয়সা বা প্রায় ৭৮ শতাংশ বাড়াতে হবে। যেখানে বর্তমানে বিদ্যুতের গড় ইউনিট মূল্য হচ্ছে ৮ টাকা ২৫ পয়সা।

দাম সমন্বয়ের নামে ভর্তুকি কমানোর মানে হলো বিদ্যুতের দাম বাড়ানো। কিন্ত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু দাম না বাড়িয়ে উৎপাদন খরচ কমাতে সরকারকে মনোযোগী হতে হবে। একইসঙ্গে বিদ্যুতের দাম সার্বজনীনভাবে না বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন এই বিশেষজ্ঞ।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম তামিম বলেন, ‘ভর্তুকি কমানোর দুটি উপায় আছে। একটি হচ্ছে ভোক্তাদের কাছ থেকে দাম বেশি নেয়া। আরেকটি হচ্ছে, উৎপাদন খরচ কমানো। উৎপাদন খরচ যদি কমিয়ে আনা যায়, তাহলে ভর্তুকির পরিমাণ কম লাগবে। তাই কিছুটা ভর্তুকি দিয়ে দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে।’

অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ভর্তুকি তুলে নেয়াটা যৌক্তিক হলেও মূল্যস্ফীতি কমাতে হবে। সেই সঙ্গে ক্রয়ক্ষমতা বাড়িয়ে বিদ্যুতের দাম সাধারণ মানুষের সক্ষমতার মধ্যে রাখতে হবে।

আইএমএফের ঋণ কর্মসূচি শুরুর পর দুই কিস্তিতে ১০০ কোটি ডলারের বেশি বাংলাদেশ পেয়েছে। চলতি মাসে তৃতীয় কিস্তিতে ৭০ কোটি ডলার পাওয়ার কথা রয়েছে।

এওয়াইএইচ