পরিষেবা
অর্থনীতি
0

সরকারি খরচ-বিনিয়োগে অর্থ ধার বাড়লেও এনবিআর বলছে ‘নেগেটিভ নয় বরং ভালো’

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বর্তমানে বাংলাদেশে যে বিনিয়োগ করা হয় তার পুরোটাই ধার করে করা। সরকারের খরচের সঙ্গে এই ধারের পরিমাণ বাড়ছে, যা ভালো বিষয় নয়। তবে এ প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেছেন, অর্থ ধার নেগেটিভ নয়, এটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য ভালো। আজ (মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল) রাজধানী গুলশানে বাংলাদেশ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) আলোচনা সভায় এসব কথা উঠে এসেছে।

পিআরআইয়ের আয়োজনে ‘বাংলাদেশ'স ডমিস্টিক রিসোর্স মোবিলাইজেশন- ইমপেরেটিভস অ্যান্ড অ্যা রোডম্যাপ' স্টাডির প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন পিআরআইয়ের পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান। আয়োজনে চেয়ার হিসেবে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান।

এছাড়া বিশেষ অতিথি হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. মাহবুবুল আলম ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।

প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, মাথাপিছু আয়ের তুলনায় দেশে রাজস্ব আদায় যে পরিমাণ কম হয়, তা অন্য কোনো দেশে দেখা যায় না।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'জাতীয় রাজস্বের ৪৩ শতাংশ চলে যায় বেতন, ভাতা ও পেনশনে। যা অনেক বেড়েছে। বাংলাদেশ যে রাজস্ব আদায় করে তা পৃথিবীর সবচেয়ে কম বলা যায়। বিশ্বের অন্য কোনো দেশে এত কম রাজস্ব আদায় দেখা যায় না।'

পিআরআই বলছে, ২০৪১ সালের মধ্যে সরকার ৯৫ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য নিয়েছে। কিন্তু বর্তমান ভ্যাট আইনে এটি ২৯ লাখ কোটি টাকার বেশি হবে না। যদি সিস্টেম পরিবর্তন করা যায়, তাহলে তা ৭৮ লাখ কোটি টাকা পর্যন্ত আয় হবে। সেক্ষেত্রে বর্তমানে স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সব প্রয়োজনীয় খাতে যেভাবে খরচ কমানো হয়েছে, তা কয়েকগুণ বাড়ানো সম্ভব হবে।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ধারাবাহিকভাবে সরকারের খরচের সঙ্গে ধারের পরিমাণ বাড়ছে। কর আহরণের বড় সমস্যা হচ্ছে সরাসরি আদায় কম। মোট করের মাত্র এক তৃতীয়াংশ আদায় হয় ডাইরেক্টলি।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশে যে বিনিয়োগ করা হয় তার পুরোটাই ধার করে করা হয়। গত ১৫ বছর বা তার বেশি সময় সরকারের কোনো সেভিংস নেই, যা মোটেও ভালো বিষয় নয়।’

পুরাতন ভ্যাট আইনে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে পিআরআইয়ের পরিচালক বলেন, ‘২০১২ সালের ভ্যাট আইনটি ঠিক ছিল। এখন যেটা আছে তাতে একাধিক পর্যায়ে একসেস ডিউটি রয়েছে। যা বিভিন্ন পর্যায়ে ক্ষতি করছে। তাই ২০১২ সালের ভ্যাট আইনে ফিরে যাওয়া দরকার। তখন ভ্যাট সিস্টেম পুরোপুরি কাজ করবে।’

সরকার চলতি অর্থবছরে ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকিং খাত থেকে নেয়ার পরিকল্পনা করেছে। যেখানে সুদ হার বাড়িয়েও এখন পর্যন্ত মাত্র এক লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা আমানত এসেছে এই খাতে। সেক্ষেত্রে মানি মার্কেট ছোট হওয়ায় ব্যক্তি-বেসরকারি এবং সরকারি খাতে অর্থায়নের বিষয়ে সমস্যা হচ্ছে বলে উঠে এসেছে পিআরআইয়ের প্রতিবেদনে।

দেশের আর্থিক খাতের উন্নতি করতে হলে আরও তিন বছর সময় লাগবে উল্লেখ করে আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'দেশের আর্থিক খাত এমনিতেই ছোট, সেটি আরও ছোট হয়ে যাচ্ছে। আর্থিক খাতের ভালো করতে যেসব উদ্যোগ নেয়া দরকার, সেগুলো এখন নিলেও কাজে আসতে অন্তত তিন বছর সময় লাগবে। যেটা আইএমএফও জানে।'

অনুষ্ঠানে এফবিসিসিআই সভাপতি মো. মাহবুবুল আলম বলেন, 'যেসব ব্যবসা এনবিআরের রাজস্ব আহরণের বাইরে আছে, তারা অনেক ভয়ংকর। তাদেরকে কর আহরণের নিয়মে আনতে হবে। শুধু ঢাকা ও চট্টগ্রামের ওপর নির্ভর করলে হবে না।'

ট্যাক্স নীতি অটোমেশনে চালু করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, 'ট্যাক্স নীতি ও আহরণের নিয়মে অটোমেশন সিস্টেম চালু করতে হবে। যখন অটোমেশন হবে তখন কর আহরণ বাড়বে। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীদের কয়েক বছরে লোকসান হয়েছে। সেজন্য এই লোকসানের বিপরীতে প্রণোদনা দরকার।'

কর রেশিও নিয়ে হতাশ না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, 'অনেকে জিডিপির তুলনায় কর রেশিও নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন। কিন্তু আমি এখানে হতাশার কিছু দেখি না। যেসব দেশের সঙ্গে এটা তুলনা করা হয়, সেসব দেশের অর্থনীতির অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে বাংলাদেশেরগুলো তুলনা করতে হবে।'

অর্থ ধারের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘অর্থ ধার করা বিষয়টি নেগেটিভ নয়, এটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য ভালো কিছু। নিজের অর্থ দিয়ে কাজ করলে ধীর গতিতে আগাতে হবে, কিন্তু ধার করে কাজ করলে অনেক দ্রুত উন্নয়ন করা সম্ভব।’

তিনি জানান, জিডিপির তুলনায় ট্যাক্স রেশিও বাড়াতে কিছু মিডেল ক্লাস পণ্যে সুযোগ সুবিধা দিয়ে কর আহরণ বাড়াতে কাজ করছে এনবিআর। রাজস্ব আহরণের যে চাপ থাকে, সেই চাপের কারণে চাইলেই অন্যান্য ক্ষেত্রে সুবিধা দেয়া সম্ভব হয় না। এটা ধীরে ধীরে করতে হয়।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘বড় বড় অবকাঠামোগুলো থেকে রিটার্ন পেতে শুরু হয়েছে, যা জিডিপিতে অবদান রাখছে। ২০০৯-১০ থেকে এখন পর্যন্ত অর্থনীতি যে অবস্থায় এসেছে তা স্বল্প সময়ে হয়নি।

এ সময় তিনি ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের এমনও কর সুবিধা দেওয়া হয়েছে যা ২৫ বছর আগের। এত বছর ধরে সুবিধা অব্যাহত রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। ব্যবসায়ীদেরকেও সে বিষয় খেয়াল করতে হবে।’

ওয়াসিকা আয়শা খান বলেন, ‘দেশের পুঁজিবাজার নিয়ে আলোচনা কম হয়। এটা নিয়ে আরো কাজ করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে অর্থায়নে শেয়ারবাজার কাজে লাগানো গেলে মানি মার্কেটের ওপরে চাপ কমবে। সেক্ষেত্রে এখানে ভালো কোম্পানির তালিকাভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে।’

অনুষ্ঠানের চেয়ার হিসেবে অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা বলেন, ‘ব্যাংকের সুদহার নির্ধারণ করে দেয়া হবে না বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হবে, তা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কতটা কাজ করবে তার ওপর নির্ভর করবে।’

তিনি বলেন, ‘এক্সচেঞ্জ রেটের দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে দেখা যায়, গত পাঁচ বছরের আগে যে দর নির্ধারণ করে রাখা হয়েছিল সেটা প্রতি বছর সমন্বয় করা হয়নি। যদি প্রতিবছর কিছু করে সমন্বয় করা হতো, তাহলে পাঁচ বছর পরে এসে সেটার ধাক্কা বড় হতো না।’

এসএস

এই সম্পর্কিত অন্যান্য খবর