দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে উৎপাদন সক্ষমতা সাড়ে ২৬ হাজার মেগাওয়াটে এনেছে সরকার। অপরদিকে পিডিবি বলছে সবশেষ ২০২৩ সালের ৯ এপ্রিল একদিনে চাহিদার বিপরীতে সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট। তবে বাড়তি সক্ষমতার পেছনে ব্যয় দাঁড়িয়েছে পাহাড়সমান।
বৈদেশিক দেনাবিষয়ক কর্মজোট বিডব্লিউজিইডি'র প্রতিবেদন বলছে, এক যুগে সরকারকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে ১ লাখ কোটি টাকারও বেশি। অপরদিকে এ বছরের মধ্যে উৎপাদন সক্ষমতা ২৯ হাজার মেগাওয়াটে নিতে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে আরও কয়েকটি পাওয়ার প্ল্যান্ট।
চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় ২৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র একক বিনিয়োগে সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ প্রকল্প। বঙ্গোপসাগরের উপকূল থেকে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে পাওয়ার প্ল্যান্টটি ২০২৩ সালের শুরুতে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়। এস এস পাওয়ার প্ল্যান্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, জাতীয় গ্রিডের চাহিদা অনুযায়ী সর্বোচ্চ উৎপাদনে যেতে প্রস্তুত তারা।
এর মধ্যে গত বছরের অক্টোবরে বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসার পর নভেম্বর থেকে পরবর্তী তিন মাসে এক দিনের সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিলো ৬০০ মেগাওয়াটের বেশি। আর ঘুরেফিরে একটি প্ল্যান্ট বন্ধ রেখে আরেকটি থেকে গড়ে সাড়ে ৪০০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে প্রতিদিন। এ জন্য কয়লার যোগান দিতে হচ্ছে ৪ হাজার টন। তিন মাসে কয়লার পেছনে তাদের ব্যয় হয়েছে ২০০ মিলিয়ন ডলার।
এ দিকে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার পরবর্তী তিন মাসে একটি ইউনিট চালু থাকলেও দু'টি ইউনিটের ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ পিডিবির কাছে এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টের পাওনা জমেছে ১ হাজার কোটি টাকা।
অপরদিকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ১০ থেকে ১২ টাকা খরচ বাবদ পাওনা দেড় হাজার কোটি টাকা। নিয়ম অনুযায়ী টাকা ও ডলারের সমন্বয়ে বিল দাখিলের পর সর্বোচ্চ দুই মাসের মধ্যে পরিশোধ না করলে অতিরিক্ত টাকাও গুণতে হবে পিডিবিকে।
এস এস পাওয়ার প্ল্যান্ট-১ এর প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা এবাদত হোসেন ভুঁইয়া বলেন, 'ক্যাপাসিটি পেমেন্টসহ বিল করেছি ৩ মাসের। যে ধরণের সামগ্রী প্রয়োজন আমরা সবগুলোই কিনেছি।'
দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সবেচেয়ে বেশি ৪৩ শতাংশ আসে গ্যাসভিত্তিক প্লান্ট থেকে, যার জন্য খরচ হয় সবচেয়ে কম, ইউনিটপ্রতি ৪ টাকা। এরপরেই ইউনিটে ১০ টাকা খরচে ১৭ ভাগ বিদ্যুৎ আসে কয়লা পুড়িয়ে। বাকিটার যোগান আসে ফার্নেস ওয়েল ও ডিজেল থেকে, যার ব্যয় অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি। এর মধ্যে খরচ উঠানামা করে আমদানি ব্যয়, ডলারের দাম, ক্যাপটিভের সক্ষমতা ও সিস্টেম লসের ওপর।
ফার্নেস ওয়েল ও এলএনজি আমদানিতে গত দুই বছরে অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া নবায়ণযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ মিলছে মাত্র ২ শতাংশের মত, যা আরও বাড়ানো সময়সাপেক্ষ। তাই কয়লার বিকল্প ভাবা কঠিন সরকারের জন্য। চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহে সে সুযোগই কাজে লাগাতে চায় এসএস পাওয়ার প্ল্যান্ট।
এসএস পাওয়ার প্ল্যান্ট-১ এর পরিচালক আলমগীর কবির বলেন, 'চট্টগ্রাম শহর এবং আশেপাশে যেসব কল-কারখানা আছে সেগুলোর চাহিদা বাড়ছে। আমাদের লক্ষ্য ছিল ১০ বছরের মধ্যে রিটার্ন নিয়ে আসা। সেভাবেই আর্থিক মডেল তৈরি করা হয়েছিল।'
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে উৎপাদনের পুরোটাই ব্যবহার করতে চাইলে বন্ধ রাখতে হবে পুরাতনগুলো। তবে সেখানেও দিতে হবে ক্যাপাসিটি চার্জ। এজন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সহায়ক নীতিমালা তৈরির পরামর্শ পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালকের।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ম তামিম বলেন, 'এ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো তো এখন ফেলেও দেয়া যাবে না, বন্ধও করা যাবে না। সে জন্য এগুলোকে চালু রাখতে হবে এবং নতুন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র যেন না হয় সে দিকে নজর রাখতে হবে। সে অনুযায়ী আমাদের কাজ করতে হবে।'
পরিবেশ রক্ষা করে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহে দ্রুতই প্রাকৃতিক গ্যাসের সন্ধান ও উত্তোলন বাড়ানোর তাগিদ বিশ্লেষকদের।