চট্টগ্রাম নগরীতে পাঁচলাইশ এলাকায় ৪৫ বছর ধরে টিকে থাকা শহরের সবশেষ তাঁত কারখানা গুটিয়ে নিচ্ছেন উদ্যোক্তারা। কারখানাটিতে এক সময় ২৫ থেকে ৩০ জন শ্রমিক কাজ করতো, এখন আছেন মাত্র পাঁচজন।
তাদের একজন বয়সের ভারে কাবু হওয়া ইসমাাইল মিয়া একসময় তাঁত কারখানার মালিক ছিলেন। জাপান থেকে আমদানি করা যন্ত্রপাতি আর সুতোয় বুনা তাঁত কাপড়ের চাহিদা ছিল দেশজুড়ে। এখন তিনি নিজেই শ্রমিক হয়েছেন।
উদ্যোক্তারা জানান, আন্তর্জাতিকভাবে সুতা ও তুলার দাম বৃদ্ধি, আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন করতে না পারা ও সর্বোপরি পুঁজির অভাবে অন্য কারখানাগুলোর মতোই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সবশেষ এ কারখানাটিও। প্রান্তিক এসব ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের কথা কী কেউ খবর নিয়েছে?
একজন তাঁতি বলেন, 'মাঝে অনেক দিন কোথাও কাজ ছিল না। এখানে কয়েকদিন কাজ করলাম, এখন এটাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতার পর থেকে এখানে অনেক তাঁত ছিল। কিন্তু বর্তমানে এই তাঁত ছাড়া আর কোনো কারখানা চালু নেই। অনেকে অনেক সুযোগ সুবিধা দেয়ার কথা বলে আসে। কিন্তু তারা চলে গেলে আর কিছুই পাই না আমরা।'
জাতিসংঘের হিসাবে বিশ্বজুড়ে ব্যবসার ৯০ শতাংশ, চাকরির ৭০ শতাংশ আর জিডিপির ৫০ শতাংশের জোগান দেয় ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটির শিল্প। সংস্থাটির হিসাবে, বাংলাদেশেও চাকরি ও ব্যবসা বাণিজ্যের ৭০ শতাংশ এ খাতের দখলে রয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, দেশে বর্তমানে কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান আছে ৬৮ লাখ ৪২ হাজার। যারমধ্যে ৫১ লাখই গ্রামাঞ্চলে। ক্ষুদ্র শিল্পের উদ্যোক্তা আছেন প্রায় ৯ লাখ ৬২ হাজার, মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তা ৭ হাজার ১০৬ জন। সব মিলিয়ে ৭৮ লাখ উদ্যোক্তার ৫৫ লাখ গ্রামে আর ২২ লাখ শহরে থাকেন।
এছাড়াও শহরে গাড়ির যন্ত্রপাতি তৈরির একটি ছোট কারখানা আছে। সেখানে কাজ করছে কিশোর ও যুবকরা। যাদের তেমন শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। দেশে ক্ষুদ্র শিল্প কারখানায় কাজ করেন এমন শ্রমিকের সংখ্যা ৭২ লাখেরও বেশি।
অভাবের তাড়নায় কারখানায় কাজ নিয়েছেন এরা। বেশিরভাগই সরকারি কোনো প্রশিক্ষণ পাননি। এসব কারখানায় বেতন, কাজের সময় নির্ধারণ, সুযোগ সুবিধা নির্ভর করে মালিকের ইচ্ছা, অনিচ্ছার ওপর। কারণ এই শ্রমিকদের দেখভাল করার কোনো সংস্থা নেই। তবুও কোন একদিন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় কাজ করছেন তারা।
একজন শ্রমিক বলেন, 'কাজ করতে করতে অভিজ্ঞতা হয়ে যায়। এক মেশিন থেকে আরেক মেশিনে কাজ করি, এর মাধ্যমে কিছু জিনিস শিখি। এভাবেই আমাদের বেতন বাড়ে। সরকারের কাছে আমাদের একটাই অনুরোধ আমাদের ডিউটিটা যেন ১২ ঘণ্টা থেকে কমিয়ে ৮ ঘণ্টায় নিয়ে আসা হয়।'
দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বড় অংশীদার নারীরা। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, শহর ও গ্রাম মিলিয়ে দেশের ৪০ লাখ ৫১ হাজার নারী এসএমই শিল্প প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত। বিউটিশিয়ান, সেলাই, বুটিকস, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতসহ নানা খাতে সফলতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে নারীরা, তারা স্বাবলম্বীও হয়েছেন।
শামীমা শিলা নামের একজন চাকরি ছেড়ে বিউটিশিয়ানের পেশায় এসে এখন সফল উদ্যেক্তাদের মধ্যে একজন। তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে ২০ থেকে ২৫ জন নারী। এই প্রতিষ্ঠানের সাথে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলে স্বাবলম্বী করছেন অন্য নারীদেরও। তবে এর শুরু থেকে তার যাত্রা কেমন ছিল? কী কী চ্যালেঞ্জ নারী উদ্যোক্তারা পার করছেন রাজধানীর বাইরে?
তিনি বলেন, 'যখনই আমরা কোনো ব্যাংক লোন বা সরকারি সহায়তার কথা বলি, তখনই প্রথম শর্ত হিসেবে এক্সপেরিয়েন্স লাগিয়ে দেয়া হয়। যারা নতুন উদ্যোক্তা তাদের তো সেই এক্সপেরিয়েন্স নেই। এই জায়গায় আমরা আসলে সবচেয়ে বড় সমস্যার মুখোমুখি হয়ে থাকি।'
দেশে প্রায় ৭ হাজার মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে ৭ লাখের মতো শ্রমিক। এসব কারখানা দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি আয়ও করছে। বৈশ্বিক সংকট, ডলারের দাম, খরচ বৃদ্ধি , প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব মাঝারি শিল্প খাতের বড় সমস্যা। তবে তার চেয়েও বড় সমস্যা হলো এ শিল্পে বৃহৎ শিল্প গ্রুপের প্রবেশ। এখনই নীতিগত সিদ্ধান্ত না নিলে ভবিষ্যতে মাঝারি শিল্প টিকে থাকবে কি না? তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন উদ্যোক্তারা।
হিফস এগ্রো ফুড লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মো শোয়াইব বলেন, 'বড় বড় কোম্পানিগুলো এখন ফুডের দিকে আসছে। তারা মুড়ি, চানাচুর করছে। কিন্তু এগুলো আসলে এসএমই করার কথা। এখানে বড় প্রতিষ্ঠানের কাজ নীতিমালা দিয়ে সহযোগিতা করা।'
ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটির শিল্প খাতকে এগিয়ে নিতে ২০০৭ সালে ২০০ কোটি টাকা নিয়ে দেশে যাত্রা শুরু করে এসএমই ফাউন্ডেশন। এ পর্যন্ত তারা প্রায় ৮ হাজার ৬০০ উদ্যোক্তাকে ঋণ দিয়েছে। আশার কথা হলো, এই উদ্যোক্তাদের এক শতাংশও ঋণখেলাপি নন, তাই ২০০ কোটি টাকার ফান্ডের আকার এখন ৭১৬ কোটি টাকা।