সঞ্চয়পত্র বহু বছর ধরে দেশের মধ্যবিত্তের বিনিয়োগের আস্থার জায়গায় হয়ে উঠেছে। কিন্তু বর্তমানে সঞ্চয়পত্র ক্রয়ের চেয়ে বিক্রি হারই বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের আগস্টে সঞ্চয়পত্রে গ্রাহকদের নিট বিনিয়োগ ছিল ২ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। কিন্তু চলতি বছরের আগস্টে বিক্রি কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২৮৯ কোটিতে। অর্থাৎ, এক বছরে বিক্রি কমেছে ৮৭ শতাংশেরও বেশি।
অন্যদিকে যারাও সঞ্চয়পত্র কিনছেন তারাও ব্যাংকিং খাতে টাকা রাখাকে ঝুঁকি মনে করে সঞ্চয়পত্র ক্রয়ে আগ্রহী হয়েছেন। ডাক বিভাগে সঞ্চয়পত্র কিনতে এসেছেন প্রবাসী শামীম ও তার স্ত্রী। জানালেন তাদের শঙ্কার কথা।
সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীরা জানান, দেশের এই অবস্থায় ব্যাংকের ওপর ভরসা রাখতে না পারায় সঞ্চয়পত্রে টাকা রাখার চিন্তা করেছি। এটার ওপর ভরসা আছে যে জনগণ পাবে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মানুষ এখন সেভিংস থেকে বের হয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। মূল্যস্ফীতি, আয় কমে যাওয়া, কর্মসংস্থানে ভাটা, সব মিলিয়ে মধ্যবিত্তের হাতে বাড়তি টাকা নেই। ফলে বড় একটি অংশ ভেঙে ফেলছেন পুরনো বিনিয়োগ।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. শহীদুল ইসলাম জাহিদ বলেন, ‘তাদের যে পরিমাণ সঞ্চয় আছে তা দিয়ে তাদের জীবনযাত্রার মান ধরে রাখতে পারছে না। তাদের বেসিক নিড পূরণ করতে পারছে না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিও এলার্মিং। সুতরাং নতুন করে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের আগ্রহ তারা হারিয়ে ফেলেছে। বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলে হয়তো কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। নীতি সুদের হার কমানো সত্ত্বেও এর সফল সাধারণ জনগণ পাচ্ছে না।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র জানালেন, সরকারের উদ্দেশ্য এখন মানুষকে সঞ্চয়ের বদলে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা। এতে অর্থনীতিতে গতি ফিরবে, কর্মসংস্থান বাড়বে।
আরও পড়ুন:
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘জনগণের কাছে যদি অধিকতর লাভজনক বিনিয়োগের ক্ষেত্র সৃষ্টি হয় তখন স্বাভাবিকভাবে এখান থেকে সুইচ করে ওখানে যাবে। সরকার নিজেও চাচ্ছে যে জনগণের মনোযোগ সঞ্চয়ের পাশাপাশি ট্রেজারি বিলেও শিফট করুক।’
তবে বিশ্লেষকরা সতর্ক করছেন, এই নীতির ফলে অর্থনীতি পড়তে পারে লিকুইডিটি ট্রাপে। অর্থাৎ, মানুষ টাকা হাতে রাখছে, কিন্তু রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় বিনিয়োগে ভয় পাচ্ছে।
গবেষক ও অর্থনীতিবিদ ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘সুদের হার আবার কমিয়ে দেয়া হয়েছে। মানুষের সমস্ত কিছুর দাম বেশি। ১৫ শতাংশ যদি আমাকে ব্যাংকেরই সুদ দিতে হয় তাহলে ব্যবসা করে টিকে থাকা কঠিন। যার জন্য এটা কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। বড় ব্যবসায়ীরা নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করবে।’
সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়ায় সরকারের বিকল্প অর্থায়ন এখন নির্ভর করছে ব্যাংকের ঋণের ওপর। ফলে বাণিজ্য ব্যাংক খাতেও তৈরি হয়েছে চাপ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকারী ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেওয়া কমে দাঁড়িয়েছে ৭২ হাজার ৩৭২ কোটি টাকায়, তবে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ বেড়ে গেছে এক লাখ ৩৬ হাজার কোটির বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকারী ব্যাংক খাত থেকে ঋণ ৭২ হাজার ৩৭২ কোটি টাকায়, বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ- ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটির বেশি।
আইএমএফ-এর শর্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে লাগাম টানা হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সুদ হার কমানো, বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীরা পড়েছেন বিপাকে। কারণ সংসারের বড় অংশের ব্যয় তারা চালাতেন সঞ্চয়পত্রের মুনাফা দিয়ে। এখন সেটিও কমে গেলে বাড়ছে অনিশ্চয়তা।
একসময় বাজেট ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র ছিল সরকারের বড় ভরসা। এখন সেই নির্ভরতা দ্রুত কমছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, যখন মানুষ সঞ্চয়পত্র থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে,তখন অর্থনীতিতে বিনিয়োগ ও ভরসা ফিরবে কীভাবে?





