বিশ্বে জাফরানের শহর হিসেবে পরিচিত ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর রাজ্যের পাম্পোর। এখানকার কৃষি জমিতে যতদূর দেখা যায় শুধু বেগুনি রঙের জাফরান ক্রোকাস ফুলের সমাহার। মূলত ফুলের ভেতরের কেশর বা পরাগই জাফরান।
শুধুমাত্র জাফরান চাষ পাম্পোর শহরে বসবাসকারী প্রায় ৩০ হাজার পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে এই পরিবারগুলো জাফরান চাষের সাথে যুক্ত।
জাফরান চাষ।
বর্তমানে দামি এই মসলার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন জাফরান চাষিরা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হুমকির মুখে জাফরানের উৎপাদন। স্থানীয় এক জাফরান চাষির তথ্যমতে, ২০০৩ ও ২০০৪ সালে এক কানাল বা শূন্য দশমিক এক দুই একর জমি থেকে পাওয়া যেতো ১ কিলো জাফরান। আর বর্তমানে এই ১ কিলো জাফরান বা কেসর পেতে প্রয়োজন ১৫ কানাল জমি। অর্থাৎ কৃষি জমির পরিমাণ বাড়লেও কমেছে উৎপাদিত জাফরানের পরিমাণ। এতে চিন্তার ভাঁজ চাষিদের কপালে।
জাফরানের উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানে ১৩ বছর ধরে কাজ করছেন ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরে অবস্থিত ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ইন্টিগ্রেটিভ মেডিসিনের গবেষকরা। তারা বলছেন, উচ্চ মানের রোপণের উপাদানের অভাব, কম-রট রোগ ও সেচব্যবস্থার অভাবই জাফরানের উৎপাদন কমার জন্য দায়ী। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো জলবায়ু পরিবর্তন অর্থাৎ খরা ও অসময়ে বৃষ্টি।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে কোনো আবহাওয়াতে যেনো জাফরান টিকে থাকতে পারে সে লক্ষ্যে ১০ বছরেরও বেশি সময় আগে এক বড় জিন তথ্যভাণ্ডার তৈরি করেছিলেন গবেষক ড. নাশিমান আশরফ। ৬০ হাজারেরও বেশি জাফরান ক্রোকাসের জিন সিকুয়েন্স জমা রয়েছে সেই ভাণ্ডারে।
আশরফ বলেন, 'জিন শনাক্ত করে উন্নত জাফরান সৃষ্টির প্রক্রিয়া চলছে। সফলতা পেলে খরা, অন্যান্য অ্যান্টিবায়োটিক চাপ এবং কম-রট রোগ প্রতিরোধে সক্ষম হবে এসব জাফরান।'
কাশ্মীরের উত্তরে ইয়ারিখাহ তাংমার্গ অঞ্চলে দীর্ঘসময় জাফরান চাষ হয়নি। তাই অঞ্চলটি পরিদর্শন করেছেন গবেষক ড. নাশিমান আশরফ ও তাঁর দল। এখানে জাফরান চাষের লক্ষ্যে সেখানকার আবহাওয়ার জন্য উপযোগী ক্রোকাস ফুলের পরীক্ষামূলক চাষ করছেন ল্যাবে। তাঁরা আশা করছেন, পরীক্ষামূলক চাষ করা এই জাফরানগুলো তাংমার্গ অঞ্চলের খরা বা আচমকা প্রবল বৃষ্টিপাতের সাথে খাপ খাওয়াতে সক্ষম হবে।
কাশ্মীরের বিভিন্ন জায়গায় জাফরান চাষ হলেও, শুধু পুলওয়ামা উপত্যকাতে প্রতি বছর গড়ে ৬ থেকে ৮ হাজার কেজি উচ্চমানের জাফরান উৎপাদিত হয়। যা বাজারে বিক্রি হয় ২৫০ থেকে ৩০০ ভারতীয় রুপিতে।
জাফরান।
ফুলের মধ্য থেকে জাফরানের উপকরণ বের করতে বেশ দক্ষতা ও ধৈর্য্যের প্রয়োজন হয়। প্রায় ৮০০ ফুল থেকে সংগ্রহ করা যায় মাত্র ৫ গ্রাম জাফরান। এ কারণে জাফরানের দাম আকাশ ছোঁয়া। আর ১ কেজি খাঁটি জাফরান পেতে প্রয়োজন ২ থেকে ৩ লাখ ক্রোকাস ফুল। যার মূল্য প্রায় ২ হাজার ইউরো, বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় আড়াই লাখ টাকা।
অনেকেই মনে করেন জাফরান শুধুমাত্র খাদ্যের রঙ ও সুগন্ধ তৈরিতে ভূমিকা রাখে। বিরিয়ানি, কোরমা এবং মিষ্টি জাতীয় অনেক খাবারে জাফরানের ব্যবহার বাড়তি মাত্রা যোগ করে। একইসাথে রূপ চর্চায় জাফরানের বহুল ব্যবহার রয়েছে। তবে এর পাশাপাশি জাফরানের রয়েছে স্বাস্থ্য উপকারিতা। প্রাচীনকাল থেকেই জাফরানের নির্যাস বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধানে ব্যবহার হয়ে আসছে।
নিয়মিত জাফরান খেলে স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায়, সাথে অবসাদ দূর হয়। রক্তচাপ কমাতে ও রক্তস্বল্পতা দূর করতেও জাফরান সাহায্য করে, এতে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে যায়। এছাড়া অনিদ্রা দূরীকরণসহ ক্যানসার প্রতিরোধেও সহায়ক এটি।
তবে বেশি পরিমাণ জাফরান গ্রহণে অ্যালার্জি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া ভ্রুণের বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে কখনো কখনো গর্ভপাতের আশঙ্কা থাকে। প্রতিদিন দেড় গ্রাম পরিমাণে জাফরানের নির্যাস গ্রহণ স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ।