১৯৯২ সালে একদিন হঠাৎ আমাদের কুমিল্লার 'যন্ত্রণা' বাসায় গিয়ে হাজির। সঙ্গে বোন, বোনের মেয়ে, তার দুই কন্যা। দু'জন প্রকাশক বন্ধু। 'যন্ত্রণা' পরিবারের সবাই 'তব্দা' খেয়ে যাই। কী, করবো, না করবো, কী খাওয়াবো- এসব ভাবতে ভাবতেই দুই ঘণ্টা কী করে জানি কেটে যায়।
তার সঙ্গে অনেকবার দেখা হয়েছে। এক সঙ্গে অনেক সময় কাটিয়েছি। ক্রমে মানুষটাকে ভালো লাগতে থাকে। চুম্বকের মতো মানুষকে কাছে টানার এক অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তার। তিনি সবসময় নিজেই ছিলেন আসরের মধ্যমণি। প্রচণ্ড পড়াশোনা ছিল। যেকোনো বিষয় নিয়ে সারাক্ষণ কথা চালিয়ে যেতে পারতেন। তার 'সেন্স অব হিউমার' এত চমৎকার ছিল যে, কাউকে কখনো বিব্রত হতে হয়নি এ কারণে। রসিকতা কাকে বলে, কত প্রকার, যারা তার সঙ্গে মেশেননি, তাদের বোঝানো যাবে না।
১৯৯৪ সালের ১৩ নভেম্বর তার এলিফেন্ট রোডের বাসায় নেমতন্ন করেন। সন্ধ্যার পর পরই যেতে বললেন। সারাদিন দারুণ এক উত্তেজনায় কাটে। এক তোড়া ফুল কিনে তার বাসার নিচে গিয়ে দাঁড়াই। দারোয়ান খুব বেশি পাত্তা দিতে চায় না। তার সঙ্গে ইন্টারকমে কথা বলে দারোয়ান নিশ্চিত হয় যে, আমি নিমন্ত্রিত অতিথি। এরপর ভেতরে যাওয়ার অনুমতি মেলে। এলিফ্যান্ট রোডে তার বাসা। লিফটে উঠতে যাব, হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। কী করব, ভাবছি। দারোয়ান বললেন, সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতে। তার ফ্ল্যাট আট তলায়। কষ্ট হলেও হেঁটেই আট তলায় উঠি। দরজা খুলে স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বললেন, আট তলায় উঠতে খুব কষ্ট হয়েছে? আসো, আসো।
তার রুমে তেমন কোনো আসবাব নেই। একটা বুক সেলফ, একটা ক্যাসেট প্লেয়ার, অসংখ্য ক্যাসেট আর বেশকিছু ফুলের তোড়া। সবাই নিচে বসে আছেন, কার্পেটে। সেখানে পরিচয় হলো অন্যপ্রকাশের মাজহার ভাই, সময়'র ফরিদ ভাই, সূবর্ণ'র জাহাঙ্গীর ভাই, মাওলা'র মাহমুদ ভাই, প্রতীক প্রকাশনীর আলমগীর ভাই, অভিনেতা সালেহ আহমদ, মোজাম্মেল স্যারসহ অনেকের সঙ্গে। সবাই বিখ্যাত মানুষ।
আড্ডা চলছে। সে আড্ডায় শিল্প, সংস্কৃতি, গান, সিনেমা, হিমু, মিসির আলী, শুভ্র, বই মেলা-কোনোটাই বাদ যায় না। আমার মতো আরও কয়েকজন সিঁড়ি দিয়ে বেয়ে উঠেছেন। নূর ভাই হাঁপাতে হাঁপাতে এলেন। তাকে জিজ্ঞেস করলেন, এত ওপরে ফ্ল্যাট নিলেন কেন? তিনি ব্যাখ্যা দিলেন- 'মশারা পাখায় ভর করে আট তলা পর্যন্ত উঠতে পারে না, সেজন্য। দেখেন, আমার বাসায় কোনো মশা নেই। এটা মিসির আলীর যুক্তি মনে হলো।'
আড্ডার মাঝে এটা-সেটা খাবার আসছে। এর মধ্যে বিশাল বিশাল দু'তিনটে গোটা মাছ ভেজে নিয়ে আসা হলো। তিনি সবার উদ্দেশে বললেন, 'সবাই মিলে এই মাছগুলো খেতে হবে কিন্তু।'
পুরো আড্ডায় আমিই কমবয়সী মানুষ। দু'তিনটি প্রয়োজনীয় কথা বলেছি শুধু। চোখের সামনে এত এত গুণী মানুষজন। বিস্ময় নিয়ে তাদের দেখছি। সবার কথা শুনছি। একটা ঘোর লাগা অনুভূতি নিয়ে রাত দশটা নাগাদ বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসি সে ফ্ল্যাট থেকে।
তার কারণে জীবনে প্রথম সেন্টমার্টিন যাই। সেখানে ছিল তার এক টুকরো জায়গা। সে জায়গায় ছোট করে একটা টিনের বাড়ি বানালেন। নাম দিলেন- সমুদ্র বিলাস। ২০০০ সালের একদিন তাকে বললাম, সেন্টমার্টিন যাব। সমুদ্র বিলাসে থাকব।
তিনি রাজি হলেন। তবে কঠিন শর্ত দিয়ে দিলেন। বললেন, 'পূর্ণিমা দেখে যেও। আর শোনো, রাতে কোনোভাবেই সমুদ্র বিলাসে ঘুমানো যাবে না। সারারাত সমুদ্রের সামনে বসে পূর্ণিমা দেখতে হবে। এই শর্তে রাজি হলে যাওয়ার সময় একটা চিঠি নিয়ে যেও।'
সমুদ্র বিলাসের কেয়ার টেকারকে লেখা তার সে চিঠি নিয়ে আমরা তিন জন সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে রওয়ানা হই। সে সময় এখনকার মতো এত 'জাহাজ' ছিল না। দিনে দু'তিনটা ট্রলার যেত টেকনাফ থেকে। সে ট্রলারে বসার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। দু'পাশ ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। ভাড়া ছিল জনপ্রতি ৫০ টাকা। তো, সে ট্রলারে চড়ে আমাদের যাত্রা শুরু। নাফ নদী পার হয়ে বঙ্গোপসাগরে ট্রলার পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে আর আতঙ্কে আমরা দিশেহারা হয়ে পড়ি। একেকটি ঢেউয়ে ট্রলার লাফ দিয়ে উঠে যায় শূণ্যে। আমরা মাঝির হাতে-পায়ে ধরে মিনতি করি, আমাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। মাঝির দয়া হয়। ট্রলার ঘুরিয়ে আবার নাফ নদীতে আসে। সেখানে ছোট ছোট অসংখ্য মাছ ধরার নৌকা। তার একটাতে আমাদের নামিয়ে চোখের সামনে দিয়ে দুলতে দুলতে ট্রলার চলে যায় দ্বীপের দিকে। আমরা ফিরে আসি টেকনাফ। সেবার আর যাওয়া হয় না।
প্রতি ১৩ নভেম্বর তার বাসায় যেতাম। এলিফেন্ট রোড ছেড়ে তিনি চলে যান ধানমন্ডির 'দখিন হাওয়া'য়। ইতোমধ্যে তার পরিবারের অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়। গুলতেকিন ভাবি, বড় মেয়ে নোভা, মেজো মেয়ে শিলা আর ছোট মেয়ে বিপাশা। ছেলে নুহাশ। ছোট ভাই আহসান হাবীব (উন্মাদ সম্পাদক), জাফর ইকবাল স্যার, তার বোন, তার মাসহ আরো অনেকে।
২০১০ সালে এসে তার সঙ্গে আমার সম্পর্কের অবনতি হয়। সেজন্য আমি কোনোভাবেই দায়ী ছিলাম না। আমি তখন একটি হাসপাতালের পিআর বিভাগে কাজ করি। তার মা ভর্তি হলেন সে হাসপাতালে। সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার পরও তার মায়ের পরিচর্যায় কিছু ত্রুটি হয়।
এই নিয়ে ফোনে তিনি আমার সঙ্গে যা-তা আচরণ করেন। ফোনে তিনি আমাকে চিনতে পারেননি। আমি যে পরিচয় দেবো, সে সুযোগও পাইনি। তিনি রেগে গেলে কাউকে কথা বলার সুযোগ দেন না। একাই বলে গেলেন অনেকক্ষণ। একসময় থামলেন। আমি পরিচয় দেওয়ার পর কিছুটা ঠাণ্ডা হলেন। তার প্রতি প্রচণ্ড অভিমান হয়। আমি তার সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ বন্ধ করে দেই।
একদিন তার পরিবারের ঘনিষ্ঠ এক আপা আমাকে কল করে বললেন, 'মানুষটার প্রতি কোনো ক্ষোভ আর অভিমান রাখবেন না। তার ক্যানসার ধরা পড়েছে। তাকে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে চিকিৎসার জন্য। তার জন্য দোয়া করবেন।'
শুনে আমি চুপ হয়ে যাই। কী বলবো! এর কিছুদিন পর। ১৯ জুলাই, ২০১২ রাত এগারোটার দিকে সেই আপা আবার কল দিলেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, 'স্যার নেই'।
এর বেশি কিছু বলতে পারেননি তিনি। তাড়াতাড়ি টিভি ছাড়লাম। টিভির স্ক্রলে তখন দেখাচ্ছে- 'হুমায়ূন আহমেদের শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন। তার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছে পরিবার'।
এভাবে পনেরো-কুড়ি মিনিট কেটে যায়। একসময় টিভি স্ক্রলের লেখাটা পাল্টে যায়। স্ক্রলে লেখা ওঠে- 'হুমায়ূন আহমেদ আর নেই'!
মিসির আলী, হিমুর স্রষ্টা হুমায়ূন আহমেদ।
প্রিয় মানুষ, আজ আপনার জন্মদিন।
হিমুরা ভালো আছে, আপনি?
আপনি ভালো থাকুন স্যার।
আপনার আত্মার শান্তি হোক।
লেখক: মেসবাহ য়াযাদ, লেখক ও সাংবাদিক