বিনোদন , ওটিটি
সংস্কৃতি ও বিনোদন
0

নেটফ্লিক্স: ডিভিডি ভাড়া দেয়া থেকে ওটিটি জায়ান্ট

হাতের মুঠোয় বিনোদন, দর্শকদের ঘরে ঘরেই এখন প্রেক্ষাগৃহের আয়োজন। যদি জিজ্ঞেস করা হয় বর্তমান সময়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় ওটিটি মাধ্যম কোনটি? একবাক্যেই সবাই মেনে নেবেন, নেটফ্লিক্স। কিন্তু এই নেটফ্লিক্স থেকে বিনোদন দুনিয়ার ওটিটি জায়ান্ট হয়ে ওঠার যাত্রাটা কেমন ছিল?

১৯৮১ সালের দিকে দুই উদ্যোক্তা রিড হেস্টিংস এবং মার্ক র‌্যান্ডল্ফ শুরু করেন সফটওয়্যারের ব্যবসা। ৯০ এর দশকের শেষের দিকে তাদের মাথায় আসে নতুন কিছু করার। ১৯৯৮ সালে মাত্র ৩০ জন কর্মী এবং ৯২৫টি ডিভিডি নিয়ে তারা নেটফ্লিক্সের যাত্রা শুরু করেন।

তাদের এই ব্যবসাটি ছিল মূলত ডিভিডি নিয়ে। সেসময় সবচেয়ে বড় ডিভিডি শপ ছিল ব্লকবাস্টার। অনলাইন অর্ডারে ব্লকবাস্টারের কাছ থেকে ডিভিডি নিয়ে ভাড়া দেয়ার মাধ্যমে তারা ব্যবসা পরিচালনা করতেন। গ্রাহকরা নেটফ্লিক্সের ওয়েব সাইটের মাধ্যমে ডিভিডি অর্ডার করতো। নেটফ্লিক্স পরবর্তীতে নির্দিষ্ট ফি’র বিপরীতে গ্রাহকের পছন্দের সিনেমার ডিভিডিটি হোম ডেলিভারি দিত। সিনেমা দেখা শেষ হলে আগেরটি ফেরত দিয়ে আবার নতুন ডিভিডি সংগ্রহ করতেন গ্রাহকরা।

১৯৯৯ সালে নেটফ্লিক্স সর্বপ্রথম তাদের সাবস্ক্রিপশন ফি’র পদ্ধতি চালু করে। যার মাধ্যমে গ্রাহকরা একটি মাসিক সাবস্ক্রিপশন চার্জের বিনিময়ে আনলিমিটেড ডিভিডি নিতে পারতো। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার অনেক সমস্যা ছিল। কারণ গ্রাহকদের কাছ থেকে ডিভিডিটি নিয়ে অক্ষত অবস্থায় আবার ব্লকবাস্টারকে ফেরত দেয়াটা ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং। তাই তখন থেকেই বিকল্প কিছু চিন্তা করতে থাকে হেস্টিংস এবং র‌্যান্ডল্ফ। সেসময় নেটফ্লিক্স ৫০ মিলিয়ন ডলার প্রস্তাব করে ব্লকবাস্টারকে কিনে নেয়ার জন্য। কিন্তু ব্লকবাস্টার সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।

নব্বই দশকের পর থেকে নেটফ্লিক্স খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা এবং উপার্জন উভয় দিক থেকেই। কিন্তু নেটফ্লিক্সকে তখনও লোকসান গুণতে হচ্ছিলো। কেননা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম যত বড় হচ্ছিলো ততই পরিচালনা খরচ বাড়ছিলো। ২০০২ সালে নেটফ্লিক্স তাদের শেয়ার পাবলিক করে। তাদের শেয়ারের প্রারম্ভিক মূল্য ছিলো ১৫ ডলার করে।

তারপরের বছরই নেটফ্লিক্স প্রথমবারের মত লাভের মুখ দেখে। ২০০৩ সালে নেটফ্লিক্সের উপার্জন ছিল ২৭২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর লাভের পরিমাণ ছিল ৬.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

শুরু থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত চলে নেটফ্লিক্সের ডিভিডি রেন্টাল কার্যক্রম। ২০০৭ সালটা ছিল নেটফ্লিক্সের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ বছর নেটফ্লিক্স তাদের অনলাইন স্ট্রিমিং সার্ভিস ‘ওয়াচ নাও’ নিয়ে আসে। যার মাধ্যমে ইউজাররা কম্পিউটারে বসে নির্দিষ্ট ফি’র বিনিময়ে তাদের পছন্দের সিনেমা দেখতে পেত। নেটফ্লিক্সের লাইব্রেরিতে ১০০০ মুভি-সিরিজ ছিলো।  

২০০৭ থেকে ২০১১ সাল, এই ৪ বছরে নেটফ্লিক্স ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৬ মিলিয়ন থেকে বেড়ে দাড়ায় ২৩ মিলিয়নে। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ২০১৩ সালে বিনোদন দুনিয়ায় আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে নেটফ্লিক্স। এসময়  প্রথমবারের মত নেটফ্লিক্স অরিজিনাল কন্টেন্ট তৈরীর প্রতি মনোযোগী হয়।তাদের প্রথম কন্টেন্ট ছিল হাই প্রোফাইল পলিটিক্যাল ড্রামা হাউজ অফ কার্ডস। ২০১৩ এর শেষ নাগাদ নেটফ্লিক্সের গ্রাহক সংখ্যা হয় ৪৪ মিলিয়ন, যেটি আগের বছরের তুলনায় ৩৩ শতাংশ বেশি।

তার ৩ বছর পর নেটফ্লিক্সের ঝুলিতে যুক্ত হয় আরো একটি সফলতা। একসাথে ১৩০টি দেশে নেটফ্লিক্সের স্ট্রিমিং শুরু হয়। ফলে রাতারাতি একটি আমেরিকান কোম্পানি থেকে বৈশ্বিক কোম্পানিতে পরিণত হয় তারা। ২০১৭ সালে নেটফ্লিক্সের গ্রাহক সংখ্যা আমেরিকান ক্যাবল টিভি গ্রাহকের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যায়। এবছর প্রতিষ্ঠানটি তাদের নিজস্ব কন্টেন্ট ‘দ্য হোয়াইট হেলমেট’স এর জন্য প্রথম একাডেমি অ্যাওয়ার্ড জিতে নেয়। ২০১৯ এর মধ্যে ১৯০টি দেশে স্ট্রিমিং শুরু হয় নেটফ্লিক্সের। এসময় নেটফ্লিক্সের আয় দাড়ায় প্রায় ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। তবে প্রতিষ্ঠানটি অরিজিনাল কন্টেন্টের জন্য ব্যয় করে ১৫ মিলিয়ন ডলার। করোনাকালীন সময়ে ঝড়ের গতিতে এগিয়ে গেছে নেটফ্লিক্স। কোভিড মহামারীর সময় সিনেমা হলগুলোতে নতুন সিনেমার মুক্তি এবং দর্শকের আগমন বন্ধ থাকলেও নিত্যনতুন কন্টেন্ট এসেছে নেটফ্লিক্সে।

ধীরে ধীরে অ্যামাজন প্রাইম, এইচবিও ম্যাক্স, হুলুসহ অন্যান্য নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী এলেও স্ট্রিমিং জগতে এখনও এগিয়ে নেটফ্লিক্স। ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এক বছরে নেটফ্লিক্সের লাভ দাঁড়ায় প্রায় ১২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। মূলত মানুষ যেভাবে কোন শো দেখতো, তার পুরো প্রক্রিয়াটাই পাল্টে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। নেটফ্লিক্সের হাতে এত বেশি শো এবং মুভি আছে যে, তারা যদি আগামী ৬ মাস কোনকিছু নাও তৈরি করে, তাও তাদের কন্টেন্টের কোন অভাব হবে না। কিন্তু তাও তারা বসে নেই। নতুন নতুন কন্টেন্ট যুক্ত করে চলেছে নিজেদের লাইব্রেরিতে।

তবে নেটফ্লিক্স থেকে ওটিটি জায়ান্ট কোম্পানিতে পরিণত হওয়ার পেছনে ‘হাউজ অফ কার্ডস’র ভূমিকা অনস্বীকার্য। এর পাশাপাশি তারা প্রডিউস করেছে স্ট্রেঞ্জার থিংস, ব্ল্যাক মিরর, থার্টিন রিজনস হোয়াই, ব্রির্জাটন এবং সেক্স এডুকেশনের মত শো।