কিশোরগঞ্জের ইটনার লাইনপাশা গ্রামের শরীফ। বিদেশে যাওয়ার স্বপ্নে পাসপোর্ট ও টাকা জমা দেন করিমগঞ্জের নিয়ামতপুরের হেলাল উদ্দিন সাধি নামে এক ব্যক্তির কাছে। কুয়েতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে তাকে ধরিয়ে দেওয়া হয় জাল ভিসা।
এমন প্রতারণার শিকার শরীফের চাচাতো ভাই ও ভাগ্নেসহ আরও ৫ জন। তাদের কাছ থেকে হেলাল হাতিয়ে নেয় পাসপোর্টসহ ৩২ লাখ টাকা। ৫ মাস পেরিয়ে গেলেও সুরাহা না হওয়ায় তাদের বয়ে বেড়াতে হচ্ছে নকল ভিসা আর হারানো টাকার যন্ত্রণা।
শরীফ মিয়া বলেন, ‘আমার মাধ্যমে আরও ৪-৫ জনের টাকা নিয়ে, বিদেশে নিতে পারে না, বরং ভিসা আনতে গেলে ধরে আরও মার দেয়। আমি খুব বিপদে আছি ভাই।’
তার বাচ্চা ও পরিবারের দুর্দশার কথা বলতে গিয়ে এক পর্যায়ে চোখ ভিজে যায় তার। এদিকে শরীফের মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে সরকারের কাছে এর সুষ্ঠ বিচার দাবি করেন। এর বিচার না পেলে পথে বসতে হবে বলেও দাবি করেন তিনি।
স্থানীয়রা জানান, হেলাল উদ্দিন একটা বড় ধরনের প্রতারকচক্র। এ চক্র যেন অসহায় মানুষদের সঙ্গে এভাবে প্রতারণা করতে না পারে, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারকে আহ্বান জানান তারা।
৭ জুলাই কিশোরগঞ্জ শহরের শোলাকিয়ার ভাড়া বাসায় নগদ টাকা গ্রহণ করেন হেলাল উদ্দিন সাধির। এরপর পাঁচজনকে নিয়ে কিশোরগঞ্জ কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে তিন দিনের ট্রেনিং, জনশক্তি দপ্তরে ফিঙ্গারপ্রিন্ট—সবকিছুই ছিল নাটক। টাকা ফেরত চাইতে গেলে অপহরণ ও মারধরের শিকার হন শরীফ। এরপর থেকেই আর খোঁজ মেলেনি হেলাল সাধিরের।
হাওর জনপদের শরীফ-মোশারফদের গল্পটা হয়তো এখানেই শেষ করা যেত। কিন্তু সরষেতে যখন ভূতের আবাস, তখন তো কিছুটা খেতিয়ে দেখা যেতেই পারে, এ দালাল চক্র কে বা কাদের পুঁজি করে চালিয়ে যাচ্ছে এ রমরমা ব্যবসা?
আরও পড়ুন:
কিশোরগঞ্জ কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে চলছে বিদেশগামীদের তিন দিনের ওরিয়েন্টেশন ক্লাস, সেখানে দুই শতাধিক প্রশিক্ষণার্থীর বেশিরভাগই দালাল চক্রের কাছে কিছু টাকা দিয়ে এসে ট্রেনিং নিচ্ছে, ট্রেনিং শেষ হলে বাকি টাকা পরিশোধ করা হবে। এটাই নিয়ম বানিয়ে দিয়েছে দালালরা।
তারা প্রশিক্ষণকে দেখাচ্ছে সরকারি প্রক্রিয়ায় সম্পন্নের ধাপ হিসেবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, মাত্র ২০০ টাকা ফি দিয়েই যেকোনো পাসপোর্টধারী স্বাধীনভাবে এ প্রশিক্ষণ নিতে পারেন।
কিশোরগঞ্জ কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জাবেদ রহিম বলেন, ‘তারা অফিসকে দিয়ে বলবে যে এ সার্টিফিকেটটা হলে আপনি বিদেশ চলে যাবেন। সেক্ষেত্রে আসলে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। যে ভিসায় যাচ্ছে, সে ভিসাটা যদি চেক করা হতো তাহলে তারা বুঝতে পারতো যে বিষয়টি ফেইক কি না।’
এবার একটু ঘুরে আসা যাক, জেলা জনশক্তি ও কর্মসংস্থান দপ্তরে। এখানেও ভিসা ছাড়াই ফিঙ্গারপ্রিন্ট করা যায়। দালালরা এটাকে ‘সরকারি প্রক্রিয়া সম্পন্ন’ হিসেবে দেখিয়ে, নকল ভিসা হাতে ধরিয়ে ফাঁদে ফেলছেন মানুষকে।
কিশোরগঞ্জের জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসার আলী আকবর বলেন, ‘আমরা দেখার দরকার পড়ে না, আমাদের দেখতে নিষেধ করা হয়েছে। চিঠি আছে যে, ভিসা দেখার দরকার নেই। এগুলো শুধু পাসপোর্ট দেখে তোমরা ফিঙ্গার দিয়ে দিবা।’
তিনি বলেন, ‘ফিঙ্গার, রেজিস্ট্রেশন, ট্রেনিং করিয়ে বাকি টাকাটা সে বিভিন্ন কলা-কৌশলে নিয়ে যায়। এক্ষেত্রে অভিবাসী আইন, যেটার কথা আমি বলছি, আইনে সরকার বলছে যে, তুমি যাকেই টাকা দিবা, তুমি টাকা দেয়ার লিখিত ডকুমেন্ট রাখবা।’
তিনি আরও বলেন, ‘জেলা পর্যায়ে আমাদের যেটা ক্ষমতা, আমরা সঠিক লোক কি না তা যাচাই করি। ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিলেই কিন্তু সেটা পরিষ্কার হয়ে যায়।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, অসচেতনতা, দালাল চক্রের প্রভাব ও ভিসা যাচাই প্রক্রিয়ার দুর্বলতাই বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রতারণার ঝুঁকি। তাই সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে সব দেশের ভিসা চেকিং ব্যবস্থার ওপর জোর দিয়েছেন তারা।




