সিরিজ সংবাদ সম্মেলন করে ইসলামী দলগুলোর এক সুরে কথা বলার দৃশ্য আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে।
জুলাই সনদের বাস্তবায়ন, সংসদের উভয় কক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন, গণহত্যার বিচার, নির্বাচনের সমতল মাঠ কিংবা জাতীয় পার্টি ও ১৪ দল নিষিদ্ধকরণ, ইসলামী দলগুলোর দাবি অভিন্ন হলেও, ঘোষণা কেন আলাদা? আর জুলাই সনদের বাস্তবায়নের আলোচনা যখন ঐকমত্য কমিশনে চলমান, তখন রাজপথের এমন কর্মসূচির যৌক্তিকতাই বা কি? এটি কি পরবর্তী ভোটকে সামনে রেখে কোনো নির্বাচনি জোট?
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ‘আমরা এটাকে নির্বাচনি জোট মনে করছি না। এবং এ ধরনের কোনো পরিকল্পনা নিয়েও অগ্রসর হচ্ছি না। যখন জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি রচিত হবে, আর সরকার তার টাইমফ্রেম অনুযায়ী নির্বাচন করবে তখনই আমরা বলতে পারবো যে জোট হচ্ছে নাকি আমরা একক নির্বাচন করছি।’
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘আমরা চাচ্ছি ধীরে ধীরে সবাইকে অ্যাকোমোডেট করার জন্য। সবাই যেন কাছাকাছি আসতে পারি। তারপর যখন চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের সময় আসবে তখন আমরা সবাই একই মসনদে কর্মসূচি দেব।’
হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ‘সরকারকে বারবার বলেছি আমাদের আন্দোলনের দিকে ঠেলে দিবেন না, টেবিলে সমাধান করেন। আমরা এটা আগেও বলেছি এখনো বলছি। ঐক্যমত্য কমিশনের মেয়াদও বাড়িয়েছি। সময় আছে, সরকার যদি টেবিলেই সমাধান করে দেয় তাহলে তো আন্দোলন লাগবে না। আমরা আন্দোলন থেকে সরে আসবো।’
গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই বিএনপি সবজায়গায় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ফ্যাসিবাদ উৎপাদনের যে জায়গাগুলো আছে সবগুলো তারা রেখে দিতে চাচ্ছে। এখানে সংস্কার কমিশন থেকে, ঐক্যমত্য কমিশন থেকে একটা বিষয় জোর দেয়া হয়েছিলো যে, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগ কমিটি হবে আলাদা। সেটাতে তারা রাজি না। পিআর হলে সেখানে পার্লামেন্ট হবে শতভাগ ভোটে। ভোটারের ভোট নিয়ে পার্লামেন্ট হবে। তাহলে সত্যিকারের জনগণের সরকার তো পিআরে হবে।’
আরও পড়ুন:
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলে, ‘আমরা আপার হাউজ পিআরের কথা বলেছি। কিন্তু পুরো পার্লামেন্ট পিআরে হলে এটা ঘন ঘন নেপালের মতো ইলেকশন হবে। রাষ্ট্র আনস্টেবল হবে, সরকারের পয়সা খরচ হবে। মানুষকে ঘন ঘন ভুগতে হবে। পিআরটা যেহেতু এক্সপেরিমেন্টাল এটা আরও সময় লাগবে। কিন্তু আপার হাউজ অবশ্যই পিআর হতে হবে।’
নেতাদের কথা এবং রাজনৈতিক আচরণে এটা স্পষ্ট, নীতিগতভাবে দলগুলো বেশ কাছাকাছিই অবস্থান করছেন। এবং এটাও ঠিক ইসলামী দলগুলোর দাবির মধ্যে আলোচিত পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবির ব্যাপারেও তারা বেশ একাট্টা। এবং এটাও দেখা গেছে, ঐকমত্য কমিশনে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের পক্ষে কথা বলেছে প্রায় ২৬টি রাজনৈতিক দলকে, যদিও রাজনীতির মাঠে তাদের গুরুত্ব বড় দল হিসেবে নয়।
প্রশ্ন হলো, ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবেও যেখানে নিন্মকক্ষে পিআর নেই এবং সংখ্যানুপাতিক সরকার অস্থিতিশীল হয়, এমন সমালোচনাও যখন আসছে, তখন তাদের এই অবস্থান কি শুধুই একটি দাবি নাকি ভিন্ন কোন সমঝোতার চাপ? বাস্তবতা হলো, এসব কর্মসূচির ক্ষেত্রেও মিত্র হারাতে দেখা গেছে অঘোষিত এ জোটকে।
হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ‘আমাদের স্পষ্ট বক্তব্য ৫১টি দেশে যে পিআর পদ্ধতিতে সরকার হয় সেখানে কি সরকার পড়ে গেছে? অস্থিতিশীল হয়েছে? নেপাল তাদের পিআরের কারণে পড়েনি। পড়েছে তাদের জাতিগত কারণে, তাদের কালচারের কারণে। পদ্ধতির মধ্যে বিভিন্ন ক্যাটাগরি আছে, যেটা বাংলাদেশের জন্য উপযুক্ত আপনি সেটা করবেন। আগে নীতিগত একমত হন।’
যদিও আনুষ্ঠানিক কোন ঘোষণা নেই, তারপরও এটা স্পষ্ট আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে ইসলামী দলগুলো কোন একটি জোট বা সমঝোতার দিকে আগাচ্ছে। এবং বাস্তবতা হলো, রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মধ্যে সংঘটিত নতুন এই মেরুকরণ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখা যাচ্ছে, বিএনপিকে।
বিএনপির এ নেতা বলছে, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি অনুসরণ করেই রাজপথে এর জবাব দেবে বিএনপি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘রাজনৈতিক দল হিসেবে কোনো দল মাঠে যদি সেই দাবি উত্থাপন করে আমরাও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দল হিসেবে মাঠে আমাদের বক্তব্য দেব। এরইমধ্যে আমরা দিয়েছে। বাংলাদেশে নিন্মকক্ষে এবং উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি আমরা চাই না। কেন চাই না তার পক্ষে যুক্তিও আমরা দিয়েছে। বাংলাদেশে যে কালচার এবং নির্বাচনের যে ইতিহাস কোনটার সঙ্গেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এ পিআর পদ্ধতি।’
একদিকে আলোচনার টেবিলে অনৈক্য, অন্যদিকে একই দাবি আদায়ে রাজপথের কর্মসূচি। এমন অবস্থায় জুলাই পরবর্তী রাজনীতি এবং রাজপথ উত্তাপ ছড়াবে নাকি নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করবে, সেটি দলগুলোর পাশাপাশি যে অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকার ওপরও নির্ভর করছে, সেদিকেও মত দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা।




