দেশে এখন
অর্থনীতি
0

দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রাণ সঞ্চার করছে সীতাকুণ্ডের জাহাজ ভাঙা শিল্প

বিশ্বের অধিকাংশ আয়ু ফুরানো জাহাজের গল্প শেষ হয় বাংলাদেশে, এরপর খণ্ডবিখণ্ড হয়ে এসব জাহাজ প্রাণ সঞ্চার করে দেশের ছোট-বড় অসংখ্য শিল্প আর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে। আর এর ওপর নির্ভর করে আবর্তিত হয় প্রায় লক্ষ কোটি টাকার অর্থনীতি। কিন্তু হালে ডলার ও বৈশ্বিক অস্থিরতায় সংকটে জাহাজভাঙ্গা শিল্প। শীর্ষস্থান টিকিয়ে রাখতে তাই, নতুন বিনিয়োগ ও সরকারি সহায়তা চান ব্যবসায়ীদের।

রাজধানীর শ্যামপুরের দুই কক্ষের ছোট কারখানা। দিনরাত ব্যস্ত শ্রমিকের হাত আর নানা ভারী মেশিনে যেখানে উৎপাদিত হয় হাজার হাজার নাট-বল্টু। আর এগুলো যে লোহার কয়েল থেকে তৈরি তার মূল কাঁচামাল আসে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে।

কেরানীগঞ্জে বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে এমন অসংখ্য ডকইয়ার্ড। তৈরি হচ্ছে বিশ্বমানের ছোট-বড় জাহাজ। এই জাহাজ নির্মাণ শিল্পেও যে কাঁচামাল লাগে তার উল্লেখযোগ্য অংশ আসে সীতাকুন্ড থেকেই। ডকইয়ার্ড, কারখানা, রি-রোলিং মিল বা পোস্তগোলার লোহার মার্কেটগুলোকে বাঁচিয়ে রাখে পুরোনো জাহাজের লোহা লক্কর, কপিকল, নানা রকম মেশিনারি টুলস, পার্টস, লোহার দড়িসহ অসংখ্য পণ্য।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও সীতাকুণ্ডের সমুদ্র উপকূলের ৩০ কিলোমিটার এলাকাজুড়েও চোখে পড়ে জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের এক সুবিশাল অর্থনীতি। এই যেমন এখানকার এই বেসিন, স্টিলের শেলফের মতো টেকসই কিচেন আইটেমগুলোর অধিকাংশের আলাদা কদর রয়েছে নামিদামি হোটেল রেস্টুরেন্টে।

মাদামবিবির হাটের এই দোকানে জাহাজের এইসব জেনারেটর বা নানা যন্ত্রাংশ পুরোনো হলেও এগুলো রপ্তানি হয় ইউরোপ আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে। পুরোনো জাহাজের আসবাব, ক্রোকারিজ, কিচেন আইটেম, বাথরুম ফিটিংস, টিভি-ফ্রিজ-এসি, নানা রকম ক্যাবল, পাইপ ফিটিংস সবকিছুরই রয়েছে সুবিশাল বাজার।

বিশ্বে যেসব জাহাজের আয়ু ফুরিয়ে যায় তাদের প্রায় অর্ধেকের শেষ ঠিকানা হয় বাংলাদেশের এই সীতাকুন্ড উপকূল। একসময়ে দুর্গম ও পরিত্যক্ত এই এলাকা শত সংকট সত্ত্বেও বাংলাদেশকে জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পে শীর্ষস্থানে পৌঁছে দিয়েছে।

শুনলে আরও অবাক হবেন, একটি মৃত জাহাজ ভাঙলে পাওয়া যায় শতাধিক রকম পণ্য। যেগুলো প্রাণ সঞ্চার করছে দেশের ইস্পাত শিল্প থেকে জাহাজ নির্মাণ শিল্প, ব্যাংকিং, বা রপ্তানি বাণিজ্যের মতো অন্তত ৮ টি খাতে। এই শিল্পকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে ১ লাখ কোটি টাকার অর্থনীতি। অন্ধকার অধ্যায় আর হতাশার গল্প ছাপিয়ে এই খাত এখন বলছে সম্ভাবনা আর রূপান্তরের গল্প।

আরব শিপ রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিয়াজুদ্দিন সোহেল বলেন, ‘শিপ ব্রেকিংয়ে আপনার একশোর মত পণ্য হচ্ছে। এর মধ্যে ফেরাস ও নন ফেরাস ক্যাটাগরি রয়েছে। ফেরাস আমাদের দেশের বাজারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। নতুন জাহাজ তৈরির ক্ষেত্রে এটি সহায়ক। নন ফেরাস আমরা রপ্তানি করে থাকি।’

জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের উপর সবচেয়ে বেশি নির্ভর করে দেশের সুবিশাল ইস্পাত শিল্প। বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকা আয় করা এই শিল্পের ৮০ থেকে ৯০শতাংশ কাঁচামাল আসে পুরোনো জাহাজ থেকে। এর পাশাপাশি দেশের প্রায় ৪০০ রি রোলিং মিলে জাহাজের বিভিন্ন প্লেট ও সরঞ্জাম রাখে কাঁচামালের ভূমিকা, যেখানে বছরে আয় হয় ১০ হাজার কোটি টাকা। আর সারাদেশের প্রায় ১৫০ জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানেও পুরোনো জাহাজের পণ্য কাজে লাগে। যার আকারও ১০ হাজার কোটি টাকার। এছাড়া ব্যাংকিং, বিভিন্ন রপ্তানি পণ্য, অক্সিজেন, যন্ত্রাংশের বাজার, আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন গৃহসজ্জা সরঞ্জামের বাজারেও ভূমিকা রাখে এ শিল্প।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন মো. আনাম চৌধুরী বলেন, ‘জাহাজ ভাঙা শিল্প হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য ভাসমান আয়রন মাইন। শুধু আয়রন মাইন না, এখানে যতগুলো উপাদান বা যন্ত্রাংশ আছে সেগুলো আমাদের শিল্প খাতে যাচ্ছে। এখানে ১২০ থেকে ১৪০ টা আউটলেট আছে। আপনি যদি ৩০০ জাহাজ হিসাব করেন তাহলে ৪০ হাজার টন ফিনিশড গুড এদেশে আসছে।’

চীন ও ভারতকে ফেলে ২০১৮ সাল থেকে জাহাজ ভাঙ্গায় বিশ্বের শীর্ষস্থান দখল করে বাংলাদেশ। তবে ডলার ও বৈশ্বিক নানা সংকটের কারণে গত কয়েক বছর এদেশে জাহাজ এসেছে কম। ২০২২ সালে ২৮ লাখ টন কাটা হলেও গত বছর তা নেমে আসে মাত্র ১০ লাখ টনে।

এসব চ্যালেঞ্জের পরও শীর্ষস্থান টিকিয়ে রাখতে নতুন প্রজন্মের ব্যবসায়ীরা এ শিল্পে আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করছেন। যার সাথে প্রয়োজন হবে নতুন বিনিয়োগ ও সরকারি সহায়তা।

কেবল লক্ষ কোটি টাকার অর্থনীতি নয়, এ খাতের উপর নির্ভর করে অন্তত দুই লাখের লোকের জীবন-জীবিকা। সরকারও এই খাত থেকে আয় করে ১২শ থেকে ১৪শ কোটি টাকা।

এএইচ