দেশে এখন
0

দরপত্রহীন বিদ্যুৎকেন্দ্রে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ লুটপাট

রেগুলেটরি কমিশনের সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ

রাজনৈতিক বিবেচনায় বিনা দরপত্রে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। আর তার খরচ দিয়েছে সরকার। তবে মালিকানা থেকে গেছে কতিপয় ব্যক্তির হাতেই। এভাবেই ক্যাপাসিটি চার্জের নামে রাষ্ট্রীয় অর্থ লুটপাট করেছে শেখ হাসিনা সরকারের ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক সিন্ডিকেট, যার বোঝা চেপেছে জনগণের ঘাড়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্ষতি পোষাতে সংস্কারের পাশাপাশি সক্ষমতা বাড়াতে হবে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের।

শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ থেকে ২৪ সাল পর্যন্ত ১২৫টিরও বেশি সরকারি-বেসরকারি, রেন্টাল-কুইক রেন্টাল ও আইপিপি পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণ করেছে আওয়ামী লীগ সরকার।

মূলত বিশেষ আইন ২০১০ এর অধীনে বিনা দরপত্রে অনুমোদন আর নবায়ন করা এসব পাওয়ার প্ল্যান্টের মাধ্যমে কিছু আওয়ামী লীগ নেতা ও তাদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের লুটপাটের সুযোগ করে দিয়েছে তৎকালীন সরকার। অভিযোগ আছে, অপরিকল্পিত পাওয়ার প্ল্যান্ট বসালেও লুটপাটের পদ্ধতি ছিলো আইনসিদ্ধ ও ছকে সাজানো।

২০২২ পর্যন্ত আজিজ খানের মালিকানাধীন সামিট গ্রুপই ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনালকে দেওয়া হয়েছে ৭ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা। চীনা কোম্পানি এরদা পাওয়ার হোল্ডিংস নিয়েছে ৭ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা।

দেশীয় কোম্পানি ইউনাইটেড গ্রুপকে দেওয়া হয়েছে ৬ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা। রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডকে দেওয়া হয়েছে ৫ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। বাংলা ক্যাট গ্রুপ নিয়েছে ৫ হাজার ৬৭ কোটি টাকা। পায়রা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র পেয়েছে ৪ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা।

ওরিয়ন গ্রুপ ৪ হাজার ৮৬২ কোটি এবং খুলনা পাওয়ার কোম্পানি ৪ হাজার ৫৪ কোটি টাকা। পুঁজি বাজারে তালিকাভুক্ত কেপিসিএলের ৩৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সামিট গ্রুপের কাছে ও ৩৫ শতাংশ ইউনাইটেড গ্রুপের কাছে। খুলনা পাওয়ারের ক্যাপাসিটি চার্জের বড় অংশই গেছে সামিট ও ইউনাইটেডের কাছে।

এখনো বাকি আছে ২০২৩-২৪ সালের হিসাব। এ ছাড়া ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করতে গিয়ে গত ৯ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে প্রায় ১১ হাজার ১৫ কোটি টাকা।

এসব কেন্দ্রের বেশিরভাগেরই মোট বিনিয়োগের মাত্র ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বিনিয়োগকারীর, বাকি পুরোটাই ঋণ। পিডিবির মাধ্যমে সরকার সুদসহ সেই ঋণ চুক্তি অনুযায়ী শোধ করেছে ৩ বছরে।

পাশাপাশি ইকুইটি বিনিয়োগের ওপর দেয়া হয়েছে মুনাফা বা রিটার্ন অন ইকুইটি। এভাবে প্রতি বছর সরকার যে অর্থ পরিশোধ করেছে সেটাই ছিল ক্যাপাসিটি চার্জ।

তবে সরকার বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয় পরিশোধ করলেও এর মালিকানা ওই কোম্পানির কাছেই থেকে গেছে। অর্থাৎ, বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করে ঋণের টাকাও পরিশোধ করা হতো সরকারকে দিয়ে, আর একাধিকবার নবায়ন করা সেই কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জসহ বিদ্যুৎ বিক্রির টাকা গেছে কোম্পানি মালিকের পকেটে।

এর মধ্যে অবকাঠামোগত নির্মাণ সামগ্রী আমদানিতে পরিশোধিত অর্থ ও দেউলিয়া করা ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের টাকা ডলার হয়ে পাচার হয়েছে বিদেশেও।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্নীতির সুযোগ খুঁজতে অপরিকল্পিতভাবে বাস্তবায়ন করা এসব প্রকল্পের ব্যয়ভার চেপেছে জনগণের ওপরেই।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বাতিল করেছে ২০১০ এর আইন। গঠন করেছে জাতীয় কমিটিও। ইতোমধ্যে সামিট গ্রুপেরই তিনটি, বেক্সিমকোর ও ওরিয়ন গ্রুপের একটি করে, এবং ভারতের আদানীর একটিসহ দেশি বিদেশি অংশীদারিত্বের মালিকানায় মোট ১১টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের তথ্য নিয়ে কাজ করছে জাতীয় কমিটি।

যার মধ্যে আছে তেলভিত্তিক ও সোলার প্রকল্পও। এক এক করে এসব প্রকল্পের যথাযথ তদন্ত করে পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ ও সংস্কারের পাশাপাশি এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সক্ষমতা বাড়ালেই বিদ্যুৎ খাতের ক্ষতি পুষিয়ে তোলা সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতের সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানের বিগত কয়েক বছরের কার্যক্রম পুনর্মূল্যায়নের পাশাপাশি এ খাতকে প্রতিযোগিতামূলক করতে শক্ত নীতি প্রণয়নের বিকল্প নেই বলে মত সংশ্লিষ্টদের।

এএইচ