স্ত্রী মমতাজের আহাজারি যেন থামছেই না। নয় দিন পর খোঁজ মিলেছে তার স্বামী আমানত উল্লাহর, তাও লাশ হয়ে। পুলিশের গুলিতে ঝাঁজরা হয়েছে আমানতের শরীর।
আমানত-মমতাজ দম্পতির গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায় হলেও থাকতেন নারায়নগঞ্জে। সেদিন জরুরি কাজে বাইক নিয়ে বের হয়ে, আর খোঁজ মিলেনি। তার এমন মৃত্যুতে চার সদস্যের পরিবারকে ভাসিয়েছেন অথৈ সাগরে।
মমতাজ বলেন, 'আমার মেয়েটা আসার সময় বলেছে, বাবাকে ফিরে নিয়ে এসো।'
রাজধানীর হাসপাতালের সামনে প্রতিদিন এমন অনেকেই ভিড় করছেন, যাদের স্বজন হারিয়েছে ছাত্র আন্দোলনে। এ যেমন রাজশাহীর চর ঘাটের পরানপুর হাট এলাকার বাসিন্দা অটো চালক জাকির হোসেন। রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর থেকে রিকশা নিয়ে বের হয়ে আর ফেরেননি গ্যারেজে।
একজন রিকশাওয়ালা বলেন, 'রিকশা নিয়ে বের হয়েছে কিন্তু এখন পর্যন্ত তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এলাকায় না পেয়ে মেডিকেলে খুঁজতেছি। কোথাও না পেয়ে সবশেষ মেডিকেলে খুঁজতে আসছি। প্রতিটি গলিতে গলিতে খোঁজা হয়েছে, কেউ খোঁজ দিতে পারছে না।'
এর বিপরীত চিত্রও রয়েছে রাজধানীর মর্গগুলোতে। আন্দোলন ঘিরে বেড়েছে অজ্ঞাত মরদেহের সারি। স্বজনদের খোঁজ না মেলায় ঠাঁই হচ্ছে বরফের ঘরে।
১৭ জুলাই থেকে ৬ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সৃষ্ট সহিংসতায় ১৮৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ সময়ে প্রাণ হারিয়েছেন ৪১ জন। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে প্রাণ হারায় আরও ৩ জন।
সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনের সহিংসতায় নিহত অজ্ঞাত ২০ জনের মরদেহ পড়ে আছে রাজধানীর দু'টি হাসপাতালের তিনটি মর্গে। এর মধ্যে ঢাকা মেডিকেলের মর্গে ১৭টি, এবং শেরে-বাংলা নগরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে রয়েছে আরও তিনটি মরদেহ।
মর্গে দায়িত্বরতরা জানান, একসঙ্গে এত সংখ্যক ক্ষত বিক্ষত মরদেহ দেখার অভিজ্ঞতা নেই তাদের। এছাড়া, মরদেহ ফুলে ও পচে যাওয়ায় যাওয়ায় চেনার কোনো উপায় নেই।
ঢাকা মেডিকেলের মর্গ সহকারী রামুচন্দ্র দাস বলেন, 'যখন আমরা ক্ষতবিক্ষত দেহগুলো দেখেছি, তখন নিজের কাছে খারাপ লেগেছে। ভবিষ্যতে যেন এমন না হয়, সেটাই চাওয়া আমার।'
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডোম টুনটুন দাস বলেন, 'লাশ যারা পেয়েছে তারা নিয়ে নিয়ে চলে গেছে। আর বাকি যাদের কেউ পাওয়া যায়নি, তাদের আমার এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। এখানে কয়টা লাশ এসেছে তার কোনো গণনা নেই। কেউ মাথায় গুলি খেয়েছে, কেউ বুকে, এরকম অনেক আছে।'
ঢাকা মেডিকেল কর্তৃপক্ষ বলছে, অজ্ঞাত এসব মরদেহ শনাক্তে পিবিআইয়ের সাহায্য নেয়া হবে। আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করেও পরিচয় শনাক্ত না হলে অজ্ঞাত হিসেবে দাফন করা হবে।
ঢামেকের ফরেনসিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. কাজী গোলাম মোখলেসুর রহমান বলেন, 'অজ্ঞাত লাশ আমরা পেয়েছি গুলিবিদ্ধ। ১৬টা অজ্ঞাত লাশ আমরা পেয়েছি।'
প্রতি মাসে গড়ে ৪৫টি নাম-পরিচয়হীন মরদেহ দাফন করে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। তবে, গত মাসে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় ৮১টি মরদেহ দাফন করে এই সংগঠন। যাদের শেষ ঠিকানা হয়েছে রায়ের বাজার ও জুরাইন কবরস্থানে।
অধিকার আদায়ের এ আন্দোলনে নিহতরা অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে বলে মনে করেন অন্তর্বর্তী সরকারের ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ।
তিনি বলেন, 'যারা এই আন্দোলনে মহীদ হয়েছেন তারাই এই একটা সুন্দর বাংলাদেশ আমাদেরকে উপহার দিয়েছেন। তাদের প্রতিনিধি হিসেবেই এই বাংলাদেশ সরকারে আমরা আছি। বর্তমান সময়ে শহীদ পরিবাররাই বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ পরিবার।'
সহিংসতায় আহতদের চিকিৎসায় সরকারি সব ব্যবস্থা করবে অন্তর্বর্তী সরকার। সেইসঙ্গে নিহতদের পরিবারের সচ্ছলতা ফেরাতেও নেয়া হয়েছে পরিকল্পনা।
স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম বলেন, 'যারা আহত হয়েছেন তাদের চিকিৎসার সব দায়িত্ব সরকারের। আর যারা নিহত হয়েছে তাদের সকলের পরিবারের দায়িত্ব সরকারের। কাজেই আমাদের ডাটাবেজটা মোটামুটি তৈরি হয়ে গেছে। প্রায় সবগুলো হাসপাতালের ডাটা আমাদের হাতে চলে আসছে।'
তরুণদের এই আন্দোলনের অর্জনে আত্মত্যাগকারীদের যথাযথ সম্মান জানানোর পাশাপাশি রাষ্ট্র সংস্কারে মনোযোগী হওয়ার তাগিদ সবার।