আদিম মানুষের বসবাস ছিল সৌরভের রাজ্যে। প্রকৃতির নিজেরই আছে সুঘ্রাণ। পাতা, ফুল, জল-জমিনের ঘ্রাণে যে মানুষের জীবন, সেখানে আধুনিক প্রসাধনীর প্রয়োজন পড়লো কবে? যখন প্রকৃতি হারাতে শুরু করেছিল নিজের রূপ-রস-গন্ধ। বাড়তে শুরু করেছিল জনসংখ্যার ঘনত্ব। মনুষ্য বর্জ্য হয়ে উঠছিল অস্বস্তির কারণ।
রাজণ্যদের আভিজাত্যের প্রকাশ ছিল সুগন্ধি। কিন্তু মানুষের সচ্ছলতা উপযোগের সূচক বাড়াতে, সমাজের সকল অংশের মধ্যেই সুগন্ধির ঘ্রাণ নেয়ার আকাঙ্ক্ষা বাড়তে থাকে।
একজন সুগন্ধী ব্যবহারকারী বলেন, 'আমি সুগন্ধি ব্যবহার করি কারণ আমার থেকে দুর্গন্ধ পেয়ে কেউ যেন আমার দিকে খারাপ কোনো রিঅ্যাকশন না দেয়। আর এর জন্য আমার কনফিডেন্স অবশ্যই বাড়ছে। আমাদের আবহাওয়া অনেক গরম, আমরা ঘামি বেশি, সেজন্য আমাদের আতর বা পারফিউম ব্যবহার করা বেশি জরুরি।'
বিপণন গবেষণা বলছে সুগন্ধি বাজারের আকার ছিল প্রায় ৪০.১৩ বিলিয়ন ডলার এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এটি ৬৪.৪১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের সুগন্ধি পণ্য মূলত আমদানি নির্ভর। ফ্রান্স, ইতালি, মধ্যপ্রাচ্য, ভারত, এবং আমেরিকা থেকে বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকার বেশি সুগন্ধি আমদানি করা হয়।
১৯৪০ এর দশকে ঢাকায় সুগন্ধি ব্যবসা শুরু হয় মিটফোর্ট এলাকাকে ঘিরে। এখানে বিস্তার ঘটেছে সুগন্ধি বাণিজ্যের।
একজন ব্যবসায়ী বলেন, 'আমাদের এখানে ৫০ মিলিগ্রাম থেকে শুরু হয়। যারা ব্যবসা করে তারা এক কেজে থেকে ১০০ কেজি পর্যন্ত নিয়ে যায়। প্রতিটি পারফিউম কোনো না কোনো গাছের নির্যাস থেকেই তৈরি হয়।'
সুগন্ধি আমদানিতে দাপ্তরিক নানাবিধ জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়। এই প্রক্রিয়া সহজীকরণের দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ ক্যামিক্যাল এন্ড পারফিউম মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম টিটো বলেন, 'মালেয়শিয়াতে একজন ব্যবসায়ী কোম্পানি খুলতে চাইলে বা আমদানিকারক লাইসেন্স করতে চাইলে তাকে তিন দিনের মধ্যে সেই লাইসেন্স দেয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এই লাইসেন্স করতে প্রায় মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয়। সেজন্য অনেক বিদেশি উদ্যোক্তা যখন এই সিস্টেম জানে তখন বিমুখ হয়।'
বাংলাদেশ ক্যামিক্যাল এন্ড পারফিউম মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মিলন বলেন, 'একশ কোটি টাকা খরচ করে আমি একটা গোডাউন তৈরি করলাম, করার পর সেই গোডাউনের লাইসেন্সের জন্য ডিসি, টিএনও এর অফিসে এবং মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অফিসে ঘুরতে ঘুরতে আমর দুই বছর পার হয়ে গেলো, এটা হলে তো আর ব্যবসা করা সম্ভব না। ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে হলে কিছু আমলাতন্ত্রের জটিলতা শিথিল করতে হবে।'
রাজস্ব বিভাগের তথ্য জানাচ্ছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে সুগন্ধি আমদানি বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ, যার মূল্যমান প্রায় এক হাজার কোটি টাকারও দেশে বর্তমানে অনলাইনসহ প্রায় ছয় হাজার সুগন্ধির দোকান আছে। বিএসটিআই এর ২৯৯টি পণ্যের মধ্যে সুগন্ধি না থাকায় এতদিন কোনো মান পরীক্ষা ছাড়াই বাজারে বিক্রি হয়ে আসছে। তবে ভোক্তাদের স্বার্থে সুগন্ধি নিয়ে একটা গ্রহণযোগ্য মান প্রক্রিয়াধীন রয়ে বলে জানিয়েছে বিএসটিআই।
বিএসটিআইয়ের মান নিয়ন্ত্রণ পরিচালক প্রকৌশল মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, 'আমরা উদ্যোগ নিয়েছি, আবার আমাদের প্রসাধনীর যে টেকনিক্যাল কমিটি আছে, সেই কমিটিতে আমরা তিন থেকে চারটা মান চূড়ান্ত করেছি। অচিরেই সরকার এটা গেজেটভুক্ত করবেন। তখন আমদানি করলে বা দেশেই তৈরি করলে আমাদের ল্যাবে মান পরীক্ষা করা হবে। সেখানে উত্তীর্ণ হলেই এটা তৈরি করতে পারবে বা বাজারজাত করতে পারবে।'
সুগন্ধি ব্যবহার এখন আর বিলাসিতা নয়। প্রয়োজনের কারণেই এর প্রতি বাড়তি নজর দেন অনেকে। তবে, দেশে উৎপাদন না হওয়ায় পুরোটাই আমদানি নির্ভর। ফলে ডলার সংকট এবং বেশি করহারের কারণে এর পেছনে খরচ করতে হয় বেশি মূল্য। তাই ব্যবসায়ীরা বলছেন এই খাতে বাড়তি বিনিয়োগ এবং বেশি সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়, তাহলে স্বল্পদামে যেমন দেশের চাহিদা মেটাবে, তেমনই রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে অবদান রেখে সুগন্ধি ছড়াবে অর্থনীতিতে।'