শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলনে যেমন আছেন সদ্য পড়াশোনা শেষ করা চাকরিপ্রার্থীরা, তেমনি তাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন অধ্যয়নরতরাও। যে কারণে পুরো দেশব্যাপীই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তৈরি হয়েছে অচলাবস্থা। বন্ধ আছে পরীক্ষাসহ শ্রেণি কার্যক্রম।
শিক্ষার্থীদের ব্যাপক আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালে সরকারি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে সব ধরনের কোটা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। কিন্তু গেল মাসে উচ্চ আদালত একটি রায়ের মাধ্যমে ঐ প্রজ্ঞাপনকে অবৈধ ঘোষণা করে, যে কারণে আবারও মাঠে শিক্ষার্থীরা। ঐ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ রয়েছে যে কারণে বিষয়টি বিচারাধীন, কিন্তু প্রশ্ন হলো এমন পরিস্থিতিতে আবার কেন আন্দোলন করছে ছাত্ররা?
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বলছেন, আগের প্রজ্ঞাপন বাতিলের পর ফের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, 'আমরা পূর্ণাঙ্গ রায় পাচ্ছি না। শুনানি কবে হবে, সেই কথাটা বলা হচ্ছে না। এখানে আমাদের একটা অনাস্থা তৈরি হচ্ছে। এটা যদি দুই থেকে তিন বছর আপিল বিভাগে চলে তাহলে এই সময়ে কোটা পুনর্বহাল থাকবে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা মনে করি সরকারের এখানে হস্তক্ষেপের অনেক সুযোগ রয়েছে। আমরা তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে কোটা সংস্কার ২০১৮ সালে চেয়েছিলাম, এখনও চাচ্ছি। এটা আদালতের এখতিয়ার না। আমরা সংবিধান অনুযায়ী অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য কোটা চাচ্ছি। কোটা কিন্তু সরকারের নীতির বিষয়, কাকে কত শতাংশ দেয়া হবে। ১৮ সালের পরিপত্রটাই কেবল ২০১৮ সালের এখতিয়ার।'
মূলত ২০১৮ সাল পর্যন্ত সরকারি যে কোটা সুবিধা ছিল, তাতে ১০ শতাংশ করে নারী ও জেলার জন্য, উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জন্য ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ কোটার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা বরাদ্দ ছিল।
জনসংখ্যার অর্ধেক নারী, বিভিন্ন জেলা, উপজাতি ও প্রতিবন্ধীদের জন্য এসব কোটার উদ্দেশ্য ছিল সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে আনা। অপরদিকে সরকারি তালিকা অনুসারে দেশে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা আড়াই লাখের বেশি নয়, যা মোট জনসংখ্যার দশমিক শূন্য শূন্য এক চার শতাংশ। কিন্তু তাদের জন্য বরাদ্দ কোটা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদের জন্য রাখা কোটার চেয়েও ৪ শতাংশ বেশি, ৩০ শতাংশ। কিন্তু কেন?
এর উত্তর মিলবে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সরকারের নেয়া দ্য ইনটেরিম রিক্রুটমেন্ট পলিসিতে। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত মুক্তিযুদ্ধ পরিবারগুলোকে এগিয়ে আনার লক্ষ্যে তখন ৩০ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, অন্তবর্তীকালীন এই সময়সীমাটা আসলে কত দিনের? 'মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড' এর সাধারণ সম্পাদক মো. আল মামুনের কাছে প্রশ্ন করেছিল এখন টিভি।
তিনি বলেন, 'কোটা কমানোর বিষয়টা কখন আসবে। যখন দেখা যাবে যে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান বা প্রজন্মদের চাকরি দেয়ার ক্ষেত্রে পাওয়া যাচ্ছে না। তখন এটি কমানো যেতে পারে। কিন্তু এখনও তো হাজার হাজার সন্তান, নাতি-নাতনি চাকরির জন্য চেষ্টা করছে। তাদের ভাইভায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরও চাকরি দেয়া হচ্ছে না। সুতরাং এই ৩০ শতাংশ কোটার এখনও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ৩০ শতাংশ কোটার সঠিক ও পূর্ণাঙ্গভাবে ১০ বছর বাস্তবায়ন করলে এই কোটার প্রয়োজনীয়তা শেষ হবে।'
মো. আল মামুন আরও বলেন, '২০১৮ সালে যে পরিপত্রটি জারি করা হয়েছিল, এটি সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক এবং অবৈধ।'
কোটা বাতিল ও কোটা বহাল রাখার পক্ষে আন্দোলনরত উভয় পক্ষের কথায় এটা স্পষ্ট তারা কোটার যৌক্তিক সংস্কারের ব্যাপারে একমত। কিন্তু যেভাবে আন্দোলন রাজপথে গড়াচ্ছে তাতে এর সমাধান কী?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, 'যিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণকালে কোনো কোটা নেননি, তিনি হয়তো চাকরিতে এসে কোটা নিতে পারেন। এভাবে বিষয়গুলো দেখার দরকার আছে। আবার কোনো কোটা আবার চালু করা হলো কিন্তু দেখা গেলো যে ওই পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠী, যাদের জন্য কোটা দেয়া হয়েছিল, তারা মোটামুটি এগিয়ে গেছে। তখন কোটাটা রহিত করা যায়।'
তিনি আরও বলেন, 'কোটার মাধ্যমে ৫৬ শতাংশ নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি আর নেই। যে আন্দোলনটা করছে, সেই আন্দোলনের যে যৌক্তিকতা সেটি আমরা উপলব্ধি করি। কারণ যেকোনো দেশে কোটা প্রথা যেমন স্বীকৃত, আবার মেধার ভিত্তিতে নিয়োগেরও প্রয়োজন আছে। তারা কিন্তু কোটা বন্ধ করতে পারেনি। আমার মনে হয় এখনও যদি একটা আলোচনায় বসা যায়, তাহলে একটা সমাধানে পৌঁছা যাবে।'
মুক্তিযোদ্ধা কোটার পক্ষে থাকা আন্দোলনকারীরা বলছেন, ২০১৮ সালের প্রজ্ঞাপন বাতিল ঘোষণা করে দেয়া আদালতের রায়ের পর পুণরায় এই কোটার বাস্তবায়নের সুযোগ এসেছে এবং এটি করতে তারা সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগও শুরু করেছেন। অপরদিকে কোটা বাতিলের আন্দোলনও নতুন মাত্রা পাচ্ছে দিনকে দিন।
এখন কোটা সম্পূর্ণভাবে বহাল থাকবে নাকি বাতিল হবে নাকি যৌক্তিক একটা সংস্কার হবে এটি নির্ভর করছে উচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায় এবং সরকারের ওপর।