বাজেটের কথা
বাজেট ২০২৪-২৫

মানিব্যাগ থেকে লাল ব্রিফকেস; গোড়াপত্তনের গল্প

দেশের অর্থনীতিকে সাবলীল ও সহজ আঙ্গিকে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে যে মানুষগুলোর নাম চলে আসে তার মধ্যে অন্যতম সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা প্রয়াত আকবর আলি খান। তিনি কেবল সাবলীল নয়, মজার ছলে অর্থনীতির কঠিন কঠিন টার্ম ব্যাখ্যা করতেন। আর তার এই বিশেষ গুণের কারণে সাংবাদিক মহলের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিবিদদের কাছেও তিনি সমান জনপ্রিয়। আর তার কদর আরও বেড়ে যেত প্রতিবছর বাজেটের সময় এলে। বাজেটকে তিনি যেমন বিভিন্ন দিক থেকে দেখার চেষ্টা করেছেন, সেই দেখার পাশাপাশি বের হয়ে আসতো সাবলীল বিশ্লেষণ।

বাজেট কী সেই প্রশ্নে এই অর্থনীতিবিদ প্রায়ই বলতেন, বাজেট হলো সংখ্যার খেলা। তবে এই সংখ্যার খেলায় বাজেটের প্রচারণার আধিক্যই বেশি। প্রতিবছর বাজেটের সময় এলেই বড় করে ঘোষণা দেয়া হয়, বাজেটের আকার সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। যুক্তির চেয়ে এতে প্রচারণা বেশি। তথ্য এখানে সঠিক। কিন্তু তথ্যের ব্যাখ্যা একেবারেই ভুল।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা প্রয়াত আকবর আলি খান। ছবি: সংগৃহীত

সোজাসাপ্টা কথায় বাজেট

বাজেট শব্দটির উৎপত্তি ফরাসি শব্দ বোগেটি বা Boudgette থেকে। যার অর্থ মানিব্যাগ বা চামড়ার ব্যাগ, যেখানে টাকা রাখা যায়। তবে সহজ ভাষায় বলতে গেলে বাজেট হলো একটি দেশের সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের হিসাব। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারকে একটি নির্দিষ্ট সময়ব্যাপী কর্মপরিকল্পনায় চলতে হয়। আর সেই কর্মপরিকল্পনায় যেমন থাকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, তেমনি থাকে খরচের হিসাব। তার মানে সরকারের কোনো পরিকল্পনায় যে অর্থ ব্যয় হবে, তা কোন কোন খাত থেকে কিংবা কীভাবে জোগাড় হবে তার হিসাব-নিকাষই হলো বাজেট। 

বাজেট শব্দটি কেবল সরকারের আর্থিক পরিকল্পনার ক্ষেত্রে যে ব্যবহার হয়, তা কিন্তু নয়। ব্যক্তি কিংবা পারিবারিক জীবনেও এটি মিশে আছে। একজন ব্যক্তিকে যেমন সংসার চালাতে আয়-ব্যয়ের সুষ্ঠু বণ্টন মেনে চলতে হয়। আবার কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির ক্ষেত্রেও এটি সমান প্রযোজ্য। তার মানে বাজেট সর্বক্ষেত্রেই ব্যবহার্য একটি শব্দ। রাষ্ট্র এবং ব্যক্তিতে বাজেটের মূল পার্থক্য হলো পরিসর ও ক্ষেত্র। 

জাতীয় বাজেটের মূলত অংশ দুটি। একটি হলো রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত এবং সেখানে কোন কোন খাত থেকে সরকারের পরিচালন ব্যয়ের অর্থ উপার্জিত হবে সেটি উল্লেখ করা হয়। অন্যটি ব্যয়ের প্রস্তাবনা তার মানে কোন খাতে সরকারে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করবে তার পরিকল্পনা। প্রত্যেক বছর  একটি আইন প্রস্তাব বা বিল আকারে জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়। যাকে বলা হয় অর্থ বিল। এর আগে এই বাজেট বিল কেবিনেট সভায় বিবেচনা ও অনুমোদন করা হয়। পরবর্তীতে অর্থ বিল ও বাজেট জাতীয় পাশ হয়ে থাকে।

যেভাবে এলো বাজেট

কীভাবে বাজেট এলো তার দিন-তারিখ নিয়ে মতান্তর রয়েছে। কেউ কেউ বলেন ১৭৩৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে বাজেট ঘোষণা দেয়া হয়। আবার কেউ কেউ বলেন, বাজেট এসেছে তারও আগে। তাও প্রায় সাড়ে তিনশ’বছর আগে।  বলা হয় ১৭২০ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রথম জাতীয় বাজেট ও রাজস্ব নীতি উপস্থাপন করেন স্যার রবার্ট ওয়ালপোল। ১৭১১ সালে গড়ে তোলা ব্রিটিশ জয়েন্ট স্টক কোম্পানি সাউথ সি বাবলির তহবিলের উপাচার্য ছিলেন ওয়ালপোল। সরকারি এই প্রতিষ্ঠানের শেয়ারে ধস নামার পর জনগণের যেন আস্থাহীনতা না পড়েন সেজন্য তিনি একটি বাজেট তৈরি করেন। 

এ ঘটনার ১৩ বছর পর ওয়ালপোল ব্রিটিশ সরকারের করে বোঝা কমাতে রাজস্ব পরিকল্পনায় বিভিন্ন পণ্যের ওপর আবগারি শুল্কারোপের প্রস্তাব দেন। বলা হয়, ওই সময়ই ব্রিটিশ সরকারের রাজস্ব নীতিতে প্রথমবারের মতো বাজেট শব্দ প্রণয়ন করা হয়। 

তবে এ ঘটনার বিষয়ে আকবর আলী খান তার ‘বাংলাদেশে বাজেট: অর্থনীতি ও রাজনীতি’ বইয়ে বলেছেন, ১৭২৫ থেকে ১৭৪২ সাল পর্যন্ত ওয়ালপোল ছিলেন যুক্তরাজ্যের অর্থমন্ত্রী এবং কার্যত প্রথম প্রধানমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি সারাবছরই কর কমানো কিংবা কর বাতিলের দাবি পেতেন। সরকারি ও বেসরকারি, দুই খাত থেকে নতুন করারোপ বা পরিবর্তনের পরামর্শ দেয়া হত। নতুন ব্যয়ের দাবিও কার হতো ওয়ালপোলের কাছে। এসব তিনি একটি নির্দিষ্ট ব্যাগে আলাদা করে ভরে রাখতেন। অর্থবছরের শেষ দিকে যখন বাজেট তৈরির কাজ শুরু করা হতো, তখন তিনি সংগ্রহে রাখা কাগজের ভিত্তিতেই বাজেট প্রণয়ন করতেন।

শিল্পবিপ্লবের পর ইংল্যান্ডের অর্থনীতি যখন বড় হতে থাকে তখন বাজেটবিষয়ক প্রস্তাবগুলো শুধু একটা মানিব্যাগে সংকুলান হতো না। আর সেজন্য মানিব্যাগের জায়গায় শুরু হলো ব্রিফকেসের ব্যবহার। ব্রিফকেস ব্যবহারের অবশ্য আরো একটি কারণ শোনা যায়।

তৎকালীন এক্সচেকারের চ্যান্সেলর উইনস্টন চার্চিল, তার স্ত্রী ক্লেমেন্টাইন এবং সন্তান সারা এবং র‌্যান্ডলফের সাথে, এপ্রিল ১৯২৯। ছবি: সংগৃহীত

সেটি হলো বাজেটে কোন কর বাড়বে বা কোন কর কমবে, তার গোপনীয়তা বজায় রাখা অপরিহার্য। কথিত রয়েছে, এসব কারণেই বাজেটের জন্য ব্রিফকেসের প্রচলন শুরু হয়। যা আজও দেশে-বিদেশে এমনকি আমাদের দেশেও অর্থমন্ত্রীর বাজেট পেশ করার আগে তার হাতে দেখা যায়। 

ইতিহাস ঘেটে দেখা যায়, ১৭৬০ সালের দিকে বাজেটের বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত রূপ পায়। ১৭৬৪ সালে গ্রেট ব্রিটেনের হাউস অব কমন্সে বাজেটে অধিবেশনে জর্জ গ্রিনভিল স্ট্যাম্প আইনের কথা বলেন। দেশটিতে বসন্তকালের শুরুতে বাজেট দিবস অনুষ্ঠিত হতো। এভাবে দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ে বাজেটের সংস্কৃতি। যা ইউরোপ-আমেরিকা হয়ে এশিয়ার গণ্ডি ধরে চলে আসে এশিয়ায়।

উপমহাদেশের বাজেট

১৮৫৭ সালে সারা ভারতবর্ষে সিপাহী বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়লে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন ব্যবস্থা রদ হয়ে যায়। আর তখনই ভারতের চাবিকাঠি চলে যায় ব্রিটিশ রানি ভিক্টোরিয়ার হাতে। ১৮৫৮ সালে দেশটির পার্লামেন্টে পাস করা হয় ‘ভারত শাসন আইন’। রানির হয়ে ভারতের শাসনভার দেখাশোনার দায়িত্ব পেলেন ভাইসরয়। তাকে পরামর্শ দেয়ার জন্য তৈরি হয় ইন্ডিয়ান কাউন্সিল। আর অর্থসংক্রান্ত বিষয় দেখাশোনার দায়িত্ব দেয়া হয় জেমস উইলসনকে।

১৮৬০ সালের ৭ এপ্রিল জেমস উইলসন কলকাতায় ভারতে ব্রিটিশ সরকারের প্রথম বাজেট বক্তব্য দেন। তিনি ১৮৬০-৬১ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন সে সময়।

জেমস উইলসন। ছবি: উইকিপিডিয়া

সেজন্য বলা হয়, উপমহাদেশে উইলসনই প্রথম গণতান্ত্রিক ওয়েস্ট মিনস্টার সরকার পদ্ধতির আওতায় সরকারের আয়-ব্যয় ব্যবস্থাপনার বাজেট পেশ করেন। এটি আজও বাংলাদেশ কিংবা ভারতে বিদ্যমান রয়েছে।

সম্রাট আকবরের প্রবর্তিত ফসলি সনের আদলে তখন এপ্রিল-মার্চকে অর্থবছর নির্ধারণ করা হয়। তিনিই প্রথম বাজেটে আধুনিক আয়কর ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। সেজন্য এই ব্যবস্থার প্রবর্তক বলা হয় আকবরকে। যদিও তার আগে এদেশে বিভিন্ন প্রকার কর বা খাজনা প্রকৃতির রাজস্ব আয়ের ব্যবস্থা ছিলো।

পাকিস্তান আমলের বাজেট

ভারত-পাকিস্তান দেশভাগের পর এ দেশের প্রথম বাজেট মুসলিম লীগ সরকার উপস্থাপন করে। সে সময় অর্থবছর এপ্রিল থেকে শুরু হতো। যদিও পরে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার জুলাই-জুন অর্থবছর ঘোষণা করে।

ইতিহাস ঘেটে দেখা যায়, ১৯৪৮ সালের ১৬ মার্চ পূর্ববাংলা প্রদেশে প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন বসে জগন্নাথ হলের হলঘরে। ১৯৪৮-৪৯ সালের প্রথম বাজেট পেশ করেন হামিদুল হক চৌধুরী। ওই অর্থবছরে ৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা বাজেট ঘাটতি ছিল। ব্যয় বিবেচনায় ওই বাজেটের আকার ছিল সাড়ে ৪১ কোটি টাকা।

তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। ছবি: সংগৃহীত

স্বাধীন বাংলার বাজেট

স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ৩০ জুন প্রথমবারের মতো বাজেট পেশ করেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। একই সঙ্গে তিনি ১৯৭১-৭২ ও ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের বাজেটও ঘোষণা করেছিলেন।

যদিও এই তিনবারের বাজেট ঘোষণার আগে তৎকালীন মুজিবনগর সরকারের বাজেটও ঘোষণা দিয়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। স্বাধীনতা সংগ্রামে অপরিহার্য ব্যয় মেটাতে এ বাজেট দেয়া হয়। তবে বাজেটের সময়কাল ছিল জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাস। যেখানে ব্যয় ধরা হয় ৮ কোটি ৬২ লাখ ৪৮ হাজার টাকা ও রাজস্ব আয় ৭ কোটি ৭৪ লাখ ১৯ হাজার টাকা।

লেখক: সাংবাদিক

ইএ

এই সম্পর্কিত অন্যান্য খবর