সূর্যের প্রখর উত্তাপ আর তীব্র তাপপ্রবাহে দেশজুড়ে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত প্রায়। থার্মোমিটারের পারদে তাপমাত্রা যখন ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁয়েছে তখন আপনার-আমার কি খোলা মাঠে দু'দণ্ড দাঁড়ানোর দুঃসাহস হয়? সেই সাহসিকতার কাজটিই করছেন সাভারের ভাকুর্তার খেতের মজুর রেজাউল করিম। প্রতি আঁটি শাক কাটলে এক টাকার রোজগার তার। তবে তীব্র তাপে আধাঘণ্টা কাজ করলে বিশ্রাম নিতে হয় ১৫ মিনিট। তাতে কমছে রোজগার।
তীব্র গরমে শাকের আঁটি কাটছেন রেজাউল করিম। ছবি: এখন টিভি
রেজাউল করিম বলেন, 'দিনে প্রায় ১২ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। কিন্তু রোদের কারণে সে সময় কাজ করতে পারি না। ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা কাজ করতে পারি।'
আরেক ভুক্তভোগী মঞ্জুর মিয়া। ইট ভাঙার কাজ করেন তিনি। গ্রীষ্মের শুরু থেকেই দেশজুড়ে যে তাপপ্রবাহ বইছে তাতে শারীরিক ও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন তিনিও।
মঞ্জুর মিয়া বলেন, 'সারাদিন এতো পরিশ্রম করে ইনকাম নেই। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে ১৫০ টাকা পাব। এই টাকায় তো সংসার চালানো যায় না।'
জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব সরাসরি পড়ছে শ্রমজীবী মানুষের উপর। রেজাউল, মঞ্জুর ছাড়াও বিভিন্ন খাতের শ্রমিকরা পুড়ছেন দাবদাহে। পরিবারের কতগুলো ক্ষুধার্ত মুখ এবং জীবন-জীবিকার তাগিদে সূর্যের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করতে হচ্ছে তাদের।
একজন শ্রমিক বলেন, 'অনেক কাজ আছে। কিন্তুু কাজ রেখে এখন ছায়ার মধ্রে এসে বসে আছি। গরমের জন্য কাজ ঠিকমতো করতে পারছি না। তিনদিন কাজ কররে পাঁচদিন বসে থাকতে হয়।'
শ্রমজীবী মানুষের কর্মক্ষেত্র এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব নিয়ে গবেষণাধর্মী এক নিবন্ধ প্রকাশ করেছে আবহাওয়া বিষয়ক সাময়িকী নেচার কমিউনিকেশনস। তাদের হিসাবে, বিশ্বব্যাপী উষ্ণতা ও আদ্রতা বেড়ে যাওয়াতে বিশ্বে প্রতিবছর গড়ে ২২ হাজার ৮০০ কোটি শ্রমঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। যার আর্থিক মূল্য ৩০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের বেশি।
এদিকে, মাথাপিছু কর্মঘণ্টা ক্ষতির তালিকায় শীর্ষ দশ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। সেখানে বছরে ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার ৪০০ কোটি কর্মঘণ্টা। মাথাপিছু হিসাবে যা প্রায় ২৫৪ ঘণ্টা।
কাজের ফাকেঁ বিশ্রাম নিচ্ছেন ম্রমিকরা। ছবি: এখন টিভি
মাথার উপর তপ্ত সূর্য থাকায় দ্রুতই হাঁপিয়ে ওঠেন শ্রমিকরা, অতিরিক্ত তাপ বহমান থাকায় ঘামও শুকায় না। যাতে অসুস্থ হয়ে পড়েন তারা। আর ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায় ৬ থেকে ১০ ঘণ্টা কাজ করার ফলে লিভার, কিডনির মতো সংবেদনশীল অঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী রোগের আশঙ্কা এই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজীর আহমেদ বলেন, 'অতিরিক্ত তাপমাত্রা হলে সবদিক থেকে সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে। আমাদের লিবার ফাংশন, কিডনি ফাংশনের কার্যকারিতা হ্রাস হতে পারে।'
দীর্ঘদিনের দূষণের ফলাফলে এমন তাপপ্রবাহ বলে জানান পরিবেশবিদরা। আর কর্মঘণ্টায় ক্ষতির কারণে জাতীয় আয়ে পড়তে পারে ঋণাত্মক প্রভাব। তাই অতিরিক্ত তাপমাত্রা থেকে পরিত্রাণ পেতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় এগুনোর পরামর্শ।
পরিবেশবিদ অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, 'অত্যধিক তাপমাত্রার যে বিষয়টি, এটি একটি ক্রমবর্ধমান অবস্থা। এর সমাধানও একদিনে হবে না। সে কারণে আমাদের দীর্ঘ পরিকল্পনা করে সবাইকে নিয়ে সমন্বিতভাবে সমাধানের পথ খুজেঁ বের করতে হবে।'
ইতোমধ্যে টানা তাপপ্রবাহ রেকর্ড ভেঙেছে গেল ৭৬ বছরের। আগামী বছরগুলোতে দেশে তাপমাত্রা আরও বৃদ্ধির পূর্বাভাস দিচ্ছেন আবহাওয়াবিদরা। তাই কাজের প্রচলিত সময়ে অর্থাৎ দিনের মধ্যভাগের পরিবর্তে ভোরে এবং বিকেলের মতো অপেক্ষাকৃত শীতল সময়ে কর্মঘণ্টা সরিয়ে আনার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।




