প্রায় চার মাস ধরে লোহিত সাগরে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক নৌপথে পণ্যবাহী জাহাজ লক্ষ্য করে অর্ধশত হামলা চালিয়েছে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা। গাজা উপত্যকায় হামলা বন্ধের লক্ষ্যে ইসরাইলের ওপর বিশ্ব সম্প্রদায়ের চাপ বাড়ানোর কৌশল হিসেবে এ পথ বেছে নেয় ইরান সমর্থিত গোষ্ঠীটি। বিশ্ববাজারে পণ্য সরবরাহ ব্যাহতের উদ্দেশ্যে এসব হামলা থেকে বাদ পড়েনি ইরানগামী জাহাজও।
হুতিদের হামলায় ঝুঁকিতে ভারতের চাল বাণিজ্য। বিশ্বের শীর্ষ চাল রপ্তানিকারক দেশটি গেলো বছর এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত শুধু বাসমতি চালই রপ্তানি করে ৩৯৭ কোটি ডলার। আসছে এপ্রিলে, অর্থাৎ দুই সপ্তাহ পরই নতুন করে চাল রপ্তানির মৌসুম সামনে রেখে হুতিদের হামলা ঠেকাতে না পারলে চাল রপ্তানিতে ক্ষতির শঙ্কায় নয়াদিল্লি। গেলো মাসেই সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠকে আলোচনার কেন্দ্রে ছিল এ বিষয়টি।
শুধু ভারতের চাল বাণিজ্যই নয়, লোহিত সাগরে হুতিদের হামলা প্রভাব ফেলেছে তেলের দামসহ পুরো বিশ্ববাণিজ্যে। সবমিলিয়ে এশিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে চলমান ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা কেবলই বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে বাণিজ্যিক নৌপথে নিরাপত্তা বাড়াতে এবং বাণিজ্যিক জাহাজের সুরক্ষা নিশ্চিতে নিজ নিজ নৌবাহিনীর তৎপরতা বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত।
বিশ্ববাণিজ্যে জাহাজে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা অনেকটাই লোহিত সাগরের ওপর নির্ভরশীল। সুয়েজ খালের মাধ্যমে লোহিত সাগর যুক্ত হয়েছে ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে বিশ্ব বাণিজ্যের ১০-১৫ শতাংশ হয়েছে এ পথে। অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি পণ্য ছিল জ্বালানি তেল। বিশ্বজুড়ে নৌপথে কন্টেইনারের মাধ্যমে পণ্য পরিবহনের ২৫-৩০ শতাংশ হয়ে থাকে সুয়েজ খাল দিয়ে।
২০১০ সাল থেকে ভারত মহাসাগরে সোমালি জলদস্যুদের জাহাজ ছিনতাইয়ের ঘটনা বাড়তে শুরু করায় নৌপথে নিরাপত্তা সক্ষমতা ভারত বাড়িয়েছিল আগেই। হুতিদের আক্রমণের সুযোগে ফের সোমালি জলদস্যুরাও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় বাণিজ্যিক নৌপথ ও পণ্যবাহী জাহাজের নিরাপত্তা বৃদ্ধির স্বার্থে সমুদ্রে তৎপরতা বাড়িয়েছে ভারতীয় নৌবাহিনীও। কিন্তু আঞ্চলিক অন্যান্য বড় অর্থনীতির মতোই হুতিদের হামলায় সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতি পুরোপুরি এড়াতে পারেনি ভারতও।
নৌপথে পণ্য পরিবহন খরচ ধারাবাহিকভাবে বাড়ার প্রভাবও পড়ছে ভারতের বাজারে। গেলো বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসে চীনের সাংহাই থেকে ভারতের চেন্নাই পর্যন্ত জাহাজে পণ্য পরিবহন খরচ বেড়েছে ১৪৪ শতাংশ। সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ মাসে ফার্মাসিউটিক্যালস-অটোমোবাইলসহ বেশকিছু খাতে ভারত থেকে আমেরিকা-ইউরোপে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন খরচ বেড়েছে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ। তবে সবচেয়ে লক্ষণীয় মাত্রায় ভুগতে হচ্ছে ভারতের বাসমতি চাল রপ্তানিকে।
ভারতে উৎপাদিত বাসমতি চালের এক-তৃতীয়াংশের গন্তব্য পশ্চিম আফ্রিকা, উত্তর আফ্রিকা, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা। দেশটির সামগ্রিক রপ্তানি পণ্যের ৫০ শতাংশও যায় এসব অঞ্চলেই। আর এসব রপ্তানি পণ্য যায় লোহিত সাগর হয়েই। হামলার জেরে বিকল্প পথ হিসেবে বেশিরভাগ জাহাজ বর্তমানে আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণ প্রান্তের কেপ অপ গুড হোপ দিয়ে ঘুরে দীর্ঘ পথে যাওয়ায় বাড়ছে পণ্য পরিবহনের সময়, খরচ এবং জাহাজ সংকটে বন্দরে পণ্য জট।
বাসমতির পাশাপাশি জ্বালানি তেল, চা, মশলা, ফল, মহিষের মাংস রপ্তানিতেও পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। অন্যদিকে ভারতে সার, সূর্যমুখী তেল, যন্ত্রাংশ আর বৈদ্যুতিক পণ্য আমদানিও বিলম্বিত। সবমিলিয়ে টান পড়বে ভোক্তার পকেটেই, জোরালো হচ্ছে শঙ্কা।