কথায় আছে 'নদী-চর, খাল-বিল, গজারির বন; টাঙ্গাইল শাড়ি তার গর্বের ধন'। টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি। দেশ পেরিয়ে বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। বিশেষ ধরণের এবং উৎকৃষ্ট মানের সুতা দিয়ে তৈরি হয় শাড়ি। এর ফলে এটি পড়তে যেমন আরামদায়ক তেমন নরম। বোনার ধরন, রঙ, নকশা সবকিছুই আলাদা। এই শাড়ি তৈরি করতেও প্রয়োজন হয় বিশেষ দক্ষতা।
টাঙ্গাইলের শাড়ির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো পাড় বা কিনারের কারুকাজ। জরি অথবা রেশমের সুতা দিয়ে এই শাড়ির পাড় তৈরি হয়। একেকটি শাড়ি তৈরিতে সময় খরচ হয় ২ দিন থেকে ১ মাস পর্যন্ত।
টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির পুরো কাজ হয় দেশীয় পদ্ধতিতে। নিজেদের বাড়িতে তাঁত বসিয়ে কাজ করেন অনেকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ৫টি করে তাঁত বসানো হয়েছে। কোথাও ৬ টি, আবার কোথাও ১০টিও আছে। প্রত্যেকের জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা জায়গা। প্রথমে সুতা তৈরি করা হয় এরপর তা দিয়ে বোনা হয় তাঁত। প্রতিদিন সকাল ৮ টা থেকে শুরু হয়ে তাঁতিদের কাজ চলে ৫টা পর্যন্ত। মানভেদে একজন কারিগর একটি শাড়ি তৈরি করতে সময় নেয় ২ থেকে ৬ মাস পর্যন্ত। তবে সময়ের সাথে কমেছে কাজ, কমেছে মজুরি। আগে যেখানে একজন পেত ৭০০-৮০০ টাকা তা এখন কমে দাঁড়িয়েছে ৫০০-৬০০ টাকায়। এ কারণে অনেকেই পরিবর্তন করছে পেশা।
জেলার তাঁত শিল্পের সাথে জড়িতরা জানান, স্বাভাবিক সময়ে বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকার ব্যবসা হয় টাঙ্গাইলের শাড়ির। নানা কারণে গত কয়েক বছর ধরে কমেছে ব্যবসা। মূলধন, প্রয়োজনীয় উপকরণের সমস্যা, নকশা ও প্রযুক্তিগত সমস্যা, দক্ষতার অভাব, বিপণনসহ নানা সমস্যায় সম্মুখীন হচ্ছে তাঁতি সম্প্রদায়।
ডিজিটালাইজেশনের এই যুগেও হাতে কাপড় বুনছেন তাঁতিরা । তবে তারা বলছেন এখন যে অবস্থা চলছে তা চলতে থাকলে সামনের দিনগুলোতে শিল্পটি বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হবে। তাই এখনই মজুরি বাড়াতে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান তাদের।
স্থানীয় তাঁত বোর্ডের তথ্যমতে, ১৯৯২ সালে এক লাখ ৫০ হাজার তাঁতি ছিল । যা ২০১৩ সালের এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬০ হাজারে। বর্তমানে তা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। ভবিষ্যতের জন্য এ পেশা টিকিয়ে রাখতে তাঁত বোর্ডের পক্ষ থেকে প্রণোদনার পাশাপাশি নেয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ ।
বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড এর লিয়াজোঁ অফিসার রবিউল ইসলাম বলেন, "একটা পাওয়ার লুমে দিনে তিন-চারটা এমনকি পাঁচটা শাড়িও হয়। কিন্তু হ্যান্ডলুমে অনেকক্ষেত্রে দিনে একটা বা দুই দিনে একটা কিংবা সাত দিনে একটা শাড়ি তৈরি হচ্ছে। কিন্তু ঐ মূল্যটা যতক্ষণ না দিতে পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত এ টাকাটা তাঁতিদের হাতে পৌঁছাবে না। তাঁতিরা যাতে উন্নত করে এই শাড়ি তৈরি করতে পারে সেজন্য এখানে পাঁচতলা একটা ভবন হচ্ছে। এখানে তাঁতিরা প্রশিক্ষণও পাবেন।"
হ্যান্ড লুমের মাধ্যমে শাড়ি তৈরি
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়িতে এসেছে বৈচিত্র্য আর নতুনত্ব। সুতি ৪০০-২০০০, তন্তুজ জামদানি ২০০০-২৫০০, সুতি বালুচুরি ১০০০-৩০০০, হাফ সিল্ক ৮০০-২০০০, হাফ সিল্ক জামদানি ১৫০০-৬০০০, পিওর সিল্ক ১৫০০০-৬০০০০, পিওর সিল্ক জামদানি ৬০০০ থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।
টাঙ্গাইলের শাড়ি বেশ আলাদা। টাঙ্গাইলের শাড়ি রেশম দিয়ে তৈরি হলেও একটু মোটা ধরণের হয়। তবে এই শাড়ি আটপৌরে কাপড় হিসেবেও যেমন ব্যবহার করা যায়, তেমনি কোন অনুষ্ঠান, উৎসবে এমনকি অফিসেও পরা যায়। বিভিন্ন রঙ ও বাহারি নকশায় তৈরি হয় এই টাঙ্গাইল শাড়ি। যেমন হাফ সিল্ক, টাঙ্গাইল বি টি, কুমকুম, বালুচরি, সুতিপার, দেবদাস, অন্দরকলি, সানন্দা, জরিপার, হাজারবুটি, ময়ূরকণ্ঠী ইত্যাদি। নকশা ও কাপড়ের ধরন অনুসারে দাম বিভিন্ন হয়।
শাড়ির চাহিদা কমে যাওয়ায় শাড়ি উৎপাদন ও বিক্রি কমেছে জানিয়ে বিক্রেতারা বলছেন, ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান, সৌদি আরব, ভারতের বিভিন্ন রাজ্য টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সরকারি সহায়তা পেলে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এ শাড়ি রপ্তানি করা সম্ভব । এক্ষেত্রে দেশ পেতে পারে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। তবে ব্যবসায় এ অবস্থা খারাপ চলতে থাকলে এ শিল্প টিকিয়ে রাখা কষ্টকর হবে।
বিক্রেতারা বলেন, আগে যে শাড়ি তৈরিতে ৪০০ টাকা খরচ হতো, 'সেটায় এখন ৫০০ টাকার বেশি খরচ হয়ে যাচ্ছে। একবছর ধরে ব্যবসার অবস্থা বেশি খারাপ হচ্ছে। তার কারণ, কাঁচামালের দাম যেভাবে বাড়ছে, সে হারে শাড়ির দাম বাড়ে নি। ফলে কারিগরদের সে পরিমাণ টাকা দিতে পারছি না।'
ক্রেতারাও বলছেন, মানে ভালো এবং দামে কম থাকায় টাঙ্গাইলের শাড়ি তাদের পছন্দ। তবে নানা কারণে আগের থেকে দাম বেড়ে যাওয়ায় কমেছে কেনার পরিমাণ। যখন আমরা টিনেজ ছিলাম তখন আমরা ২০০ টাকা দিয়েও শাড়ি কিনেছি। আর এখন সে শাড়িগুলোর দাম বেড়ে গেছে। আবার অনেক শাড়ি পাওয়া যায় না। বিভিন্ন ব্র্যান্ডে এসব শাড়ি পাওয়া যায়। তারা যে দামে বিক্রি করে সে তুলনায় এখানে অনেক কম দামে পাওয়া যায়।
টাঙ্গাইলের শাড়ি নিয়ে হাট বসে প্রতি মঙ্গলবার। সেই হাটে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে শাড়ি কিনতে আসেন ক্রেতারা। তবে চাহিদা কমে যাওয়ায় দোকানের মতো হাটেও কমে গেছে বিক্রি।
জেলায় উৎপাদিত তাঁতের শাড়ি বিক্রির জন্য জেলার বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি সাপ্তাহিক হাট বসে। এরমধ্যে অন্যতম শতবর্ষী করটিয়া হাট এবং জেলা শহরের বাজিতপুর হাট। সারা বছর বিভিন্ন জায়গা থেকে পাইকাররা এসব হাটে এসে চাহিদামতো শাড়ি কিনে নিয়ে যান।
ঐতিহ্যপূর্ণ কারিগরি জ্ঞান ও নিষ্ঠা ছাড়া টাঙ্গাইলের শাড়ি তৈরি করা যায় না। আসল টাঙ্গাইলের শাড়ি তৈরির জন্য এর তাঁতি বা কারিগরদের শিল্পী হয়ে উঠতে হয়। টাঙ্গাইলে সেই শিল্পীরা আছেন। সেজন্যই এখানকার তাঁতশিল্প ও তাঁতের শাড়ির সুখ্যাতি এখনো বজায় আছে। তবে প্রান্তিক পর্যায়ের তাঁতিদের অস্তিত্ব রক্ষায় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের দক্ষতার উৎকর্ষ সাধন এবং জীবনমান উন্নয়নে এখনই পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে ভবিষ্যতে এ শিল্প টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যাবে বলে মনে করছেন শাড়ি বুনন ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা।