দেশে এখন
বিশেষ প্রতিবেদন
0

ভারতীয় গণমাধ্যমের অপপ্রচার কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং সংঘবদ্ধ চক্রান্ত!

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর অপপ্রচার কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং সংঘবদ্ধ চক্রান্ত হিসেবে দেখছে ফ্যাক্টচেকাররা। তারা বলছে, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর অপপ্রচারের এই প্রবণতা ব্যাপকভাবে বেড়েছে।

আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর জেরে বাংলাদেশ কন্যসুলেটে হামলার যে ঘটনা ঘটেছে; তা সুস্পষ্ট আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। কূটনীতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের বিভিন্ন পক্ষ থেকে বাংলাদেশের প্রতি আগ্রাসী এমন মনোভাবের জবাবে, কূটনৈতিক বিভিন্ন শক্ত পদক্ষেপের মাধ্যমে নিতে হবে। এসব ঘটনা বাংলাদেশ-ভারত সমমর্যাদার সম্পর্ক বিনির্মাণের বড় সুযোগ হিসেবেই দেখছেন তারা।

ছাত্র জনতার অনেক রক্তে ভেজা বিপ্লবের পর, বাংলাদেশ নিয়ে ভারতীয় প্রচারমাধ্যমগুলোর লাগামহীন অপপ্রচারের চূড়ান্ত রূপ বলা যায়, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে তোলা এমন বক্তব্যকে।

ভারতীয় এক সংবাদ উপস্থাপক বলেন, ‘বাংলাদেশ থাকবে না। বাংলাদেশ থাকবে না।’

ভারতীয় নিবন্ধিত একেকটি গণমাধ্যম থেকে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে হিন্দু নারীরা শাখা সিঁদুর পরে বেরোতে পারছে না, গুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে তাদের বাড়ি, রাতে হচ্ছে নির্যাতন, ধর্মান্তকরণ কিংবা প্রচুর মেয়ে নিখোঁজ।

কখনও কখনও দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ-এমনকি সেনাবাহিনীকে নিয়েও দেশটির বাংলা ও ইংরেজিভিত্তিক গণমাধ্যমগুলোর অপপ্রচার সম্পর্কিত পোস্টের সংখ্যা এক ঘণ্টায় ৫ থেকে ৬টি। যা হতবাক হয়ে প্রত্যক্ষ করছে, এদেশের তরুণ যুবসমাজ ।

তরুণদের একজন বলেন, ‘বিশেষ করে কলকাতার মিডিয়াগুলো বেশি অপপ্রচার চালাচ্ছে। তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও জানানো হচ্ছে যে সংখ্যালঘুদের উপর অনেক নির্যাতন করা হচ্ছে কিন্তু এখানকার দৃশ্য একদম আলাদা।’

আরেকজন বলেন, ‘বাংলাদেশের সবাই কিন্তু ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। ভারতের মিডিয়াগুলো আসলে হলুদ মিডিয়া। তারা কিন্তু রাষ্ট্রের প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে।’

কিন্তু এর পরিসর আসলে কতটা ব্যাপক? রিউমারস্ক্যান নামের একটি ফ্যাক্টচেক সংস্থা, ১২ আগস্ট থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতের ৪১টি টিভি ও পত্রিকায় প্রকাশিত, প্রচারিত সংবাদগুলো বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, ঐসব প্রচারমাধ্যমে প্রচারিত ভুয়া সংবাদের সংখ্যা কমপক্ষে ৪৯টি।

ভার্চুয়াল মাধ্যমে ছড়ানো কন্টেন্টগুলোর সত্যতা যাচাই নিয়ে কাজ করেন শুভাশীষ দীপ। তিনি বলছিলেন, পুরোনো ছবি ও ভিডিও দিয়ে ভুয়া কন্টেন্ট তৈরি, মিথ্যা তথ্য দিয়ে ফেসবুক পোস্ট, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ও ন্যারেটিভ তৈরি- এসব পথ বেছে নিচ্ছে পাশ্বর্বর্তী দেশের গণমাধ্যমগুলো।

ফ্যাক্টওয়াচের ফ্যাক্ট-চেকার শুভাশীষ দীপ বলেন, ‘যারা এইসব ছড়াচ্ছে তারা সবাই ভারতের নিবন্ধিত মেইনস্ট্রিম মিডিয়া।’

তার পর্যবেক্ষণ হলো, কথিত সংবাদমাধ্যমগুলোর এই প্রচারণাগুলো অনিচ্ছাকৃত কোনো ভুল নয়, বরং বাংলাদেশ বিরোধী সংগঠিত কোনো প্রচারণা।

ফ্যাক্টওয়াচের ফ্যাক্ট-চেকার শুভাশীষ দীপ বলেন, ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা হলে তারা কিছুটা ভুল করতো আরকি। কোথাও থেকে ইনফরমেশন নিলে একটু এদিক সেদিক হতে পারে। আপনি যদি তাদের পোস্টের ভাষা দেখেন তাহলে বুঝতে পারবেন এইগুলা আসলে একদমই ফেক নিউজ। এইটার কারণ তারা আগে যে লেন্সে বাংলাদেশকে দেখতো, এখন তার সব কিছু পরিবর্তন হচ্ছে, এটা তারা মেনে নিতে পারছে না।’

এই ফ্যাক্টচেকারের কথায় এটা স্পষ্ট, এসব অপপ্রচারের বিপরীতে ব্যক্তিগতভাবে অভিযোগ জানানো বা রিপোর্ট করা থেকে শুরু করে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদেরও সম্মিলিত প্রয়াস দরকার বাংলাদেশের পক্ষে। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে কি কোনো পদক্ষেপ নেবার সুযোগ আছে, যেখানে এসব অপপ্রচারের জেরেই আগারতলায় বাংলাদেশ কনস্যুলেটে হামলার ঘটনাও ঘটেছে।

আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ কাজী ওমর ফয়সাল বলছেন, এ ধরনের হামলা কূটনীতিক সম্পর্ক বিষয়ক আন্তর্জাতিক দলিল Vienna Convention on Diplomatic Relations-VCDR 1961 ভিয়েনা কনভেনশনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। যেহেতু বাংলাদেশ ও ভারত উভয়েই এই কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ, সে হিসেবে কী এর প্রতিকার পাবার সুযোগ আছে?

আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ কাজী ওমর ফয়সাল বলেন, ‘এই ধরনের ঘটনা আসলে ১০ বছরে দুই থেকে তিনটা ঘটে। ভিয়েনা কনভেনশনের আর্টিকেল ২০ এর ২ ধারায় বলা হচ্ছে অল নেসেসারিস মেজার। এক্ষেত্রে ফেক ইনফরমেশনকে একটা যে ফিল্টার করা বিষয় থাকে সেটা কিন্তু ভারত করতে পারতো।’

এই বিশেষজ্ঞ সীমাবদ্ধতার যে দিকটি উল্লেখ করেছেন, সেটি হলো এই অপশনাল প্রটোকলটিতে স্বাক্ষর না করা। যদিও পার্শ্ববর্তী ভারত, পাকিস্তান, নেপালসহ ৭৬টি দেশ এই কনভেনশনে সই করেছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকে ড. রহুল আমিনের কাছে প্রশ্ন ছিল, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সম্পর্কের যে সূত্র, তাতে আইন নাকি আলোচনা, কোন পথে এগোবে বাংলাদেশ।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকে ড. রহুল আমিন বলেন, ‘এই যে মোদি সরকার সে তো একটা মৌলবাদী সরকার। সে তো অসুস্থ সরকার। তার কাছ থেকে কোনো ভালো সেন্সের রিয়েকশন আসা করতে পারি না। তারপরেও টেবিলে দুইটা এজেন্ডা থাকবে এক কূটনৈতিক আরকেটা স্ট্রং ম্যানশীপের বার্তা ভারতকে দিতে হবে।’

এই বিশ্লেষকের মতে, একটা দীর্ঘ সময়ের ধরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে একটা অসম সম্পর্ক, জুলাই বিপ্লবের পর সেটাকে সমমর্যাদার সম্পর্কে রূপ দেবার সুযোগ এসেছে। এদিক থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপ যথাযথ নয় বলেও সমালোচনা করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যয়নের এই শিক্ষক।

ইএ