১৮ জুলাই, যাত্রাবাড়ীতে গুলিবিদ্ধ নিহতদের রক্তাক্ত স্তূপের মধ্যে আটকে পড়া মুমূর্ষের হাতের ইশারায় ছুটে গিয়েছিলেন নারী শ্রমিক পারভীন। তাকে টেনে বের করতেই আবারো পুলিশের গুলি। বুকের ওপরে লাশ হয়ে গেল অচেনা সেই যুবক। ততক্ষণে একটি গুলি চোখ ভেদ করে পারভীনের কর্নিয়ায় আঘাত হানে। বাম চোখে অন্ধকার নেমে আসে পারভীনের।
নারী শ্রমিক পারভীন বলেন, ‘এমনভাবে মানুষ মারা গিয়েছে কারো হাত নেই, পা নেই। মনে হচ্ছে গরু জবাই করলে যেমন রক্ত তেমন রক্ত যাত্রাবাড়িতে। একটা ছাত্র এত মানুষের মধ্য দিয়ে ও নাড়া দিয়ে উঠছে। পরে আমি দৌড়ে গিয়েছি ওরে ধরলাম। ওপার থেকে পুলিশ দৌড়ে বের হয়ে গুলি করা শুরু করলো আবার। ওই ছেলেটা আমার বুকে মারা গেল।’
৬ মাস পর শ্রীলঙ্কা থেকে আনা কর্নিয়ায় নতুন করে চোখের আলো ফিরেছে তার।
পারভীন বলেন, ‘গুলি যখন আমার চোখে এসে পড়লো তখন মনে হলো এত বড় ইট চোখের মধ্যে কেউ মেরে দিয়েছে। এত খারাপ লাগছে মনে হলো কলিজা বের করে নিয়ে গেল। আর যে ছেলেটে মারা গেছে ওর কথা মনে পড়লে সেদিন আমার ঘুম আসে না। আমার হাত পা দুর্বল হয়ে যায়।’
বরিশালে গুলিবিদ্ধ হয়ে ডান চোখের দৃষ্টি হারিয়েছিল তরিকুলও। আন্তর্জাতিক সংস্থা ফেডারেশন অব ইসলামিক মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন ও নিউইয়র্ক প্রবাসী হাফিজুর রহমানের সহযোগিতায় শ্রীলঙ্কা থেকে আনা দুটি কর্নিয়া পারভীন ও তরিকুলের চোখে প্রতিস্থাপন করা হয়। প্রতিস্থাপন সম্পূর্ণ ব্যয়ভার বহন করেছে ভিশন আই হাসপাতাল।
তরিকুল বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের এক আঙ্কেলের সাথে কথা হয় মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান। তার মাধ্যমে হাসপাতালের সাথে যোগাযোগ করে এখানে আসি। এরপর এখানে কর্নিয়া প্রতিস্থাপন হয় আমার।’
আন্দোলনে আহত কর্নিয়া গ্রহীতাদের ধানমন্ডির ভিশন আই হাসপাতালে যোগাযোগের আহ্বানের জানানো হয়েছে। তবে প্রথম দুটি বিনামূল্যে করে দিলেও পরবর্তী প্রতিস্থাপনের ব্যয় বহন করতে দাতব্য সংস্থা বা যে কোনো হৃদয়বানের সহযোগিতা চেয়েছে হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। জানালেন শ্রীলঙ্কা থেকে কর্নিয়া পাবার সহজ রাস্তা মিলেছে।
ভিশন আই হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অধ্যাপক ডা. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘কেউ যদি আমাদেরকে নাম লিখে দেয় কর্নিয়া লাগবে এবং একজন ব্যক্তি যদি এইটার দায়িত্ব নেই তাহলে আমাদের কাছে তালিকা থাকবে। আমরা চাই রোগি এবং ব্যক্তি সরাসরি আমাদের সাথে যোগাযোগ করুক।’
জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের তথ্য বলছে, আন্দোলনে সারাদেশে গুলিবিদ্ধ হয়ে এক চোখের আলো হারিয়েছেন ৫ শতাধিক, পঞ্চাশের বেশি দু'চোখের আলো হারালেও একেবারে কিছুই দেখতে পান না প্রায় ২০ জন। চোখে আঘাতপ্রাপ্তদের প্রায় ৭০ শতাংশ মানসিক অস্থিরতায় ভুগছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আঘাত পাবার দু সপ্তাহ পরেও যারা চোখের সঠিক চিকিৎসা পাননি তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
ভিশন আই হাসপাতালের চেয়ারম্যান ও সিইও ডা. মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘যেকোনো মেটাল প্লেটের আঘাত চোখ আসলে সহ্য করতে পারে না। এইটা কম্পাউন্ড ইনজুরি হয় আসলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে গুলি চোখের পিছে চলে যায়। যার ফলে এইটা বের করা যায় না। ফলে দৃষ্টিশক্তি স্থায়ীভাবে ড্যামেজ হয়ে যায়।’
আন্দোলনে চোখে আঘাতপ্রাপ্ত প্রায় ১১শ' জনের মধ্যে প্রায় ৭০ জনের কর্নিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যাদের অন্তত ৪০ জনের কর্নিয়া প্রতিস্থাপন একান্তভাবে প্রয়োজন। দেশে কর্নিয়া না থাকায় দীর্ঘ ৬ মাসে মাত্র ৪ জনের কর্নিয়া প্রতিস্থাপন সম্ভব হয়েছে। এই দুজনের মতো বাকিদের কর্নিয়া প্রতিস্থাপনে চেষ্টা করে যাচ্ছে ভিশন আই হাসপাতাল।