মুসলমানদের জন্য বাধ্যতামূলক ইবাদত হজ। প্রত্যেক সামর্থ্যবান মানুষের ওপর জীবনে একবার হজ করা ফরজ। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর একটা বড় অংশ যায় হজ পালনে। প্রাক নিবন্ধন থেকেই হজ নিয়ে আগ্রহ শুরু হয় যাত্রীদের।
অথচ ২০২৩ ও ২০২৪ সালে উল্টো চিত্র দেখেছে দেশ। গেলো বছর নয় দফা সময় বাড়িয়েও পূরণ করা যায়নি কোটা। আর চলতি বছর পাঁচ দফা সময় বাড়ানোর পরও বাকি ছিলো কোটার ৪৪ হাজার।
সিন্ডিকেট করে প্যাকেজের দাম বাড়ানো, শর্ত অনুযায়ী সেবা না পাওয়া, ভিসা জটিলতা আর এজেন্সির প্রতারণায় হজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে মুসল্লীরা। খরচ বাড়ায় সাধ্যের বাইরে চলে গেছে ইসলামের অন্যতম বাধ্যতামূলক এই ইবাদত।
আল মক্কা ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী মুহাম্মদ খোরশেদ আলম বলেন, ‘কভিডের পর যেভাবে হুহু করে হজ প্যাকেজ বেড়ে গেল, যার কারণে কভিডের পর আমাদের হজের কোটা পূরণ হচ্ছে না।’
কারসাজি করে প্যাকেজের দাম বাড়ানোর সিন্ডিকেটের পেছনের হোতা হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি এম. শাহাদাত হোসাইন তসলিম। যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হওয়ায় কর্তৃত্ববাদী আওয়ামীলীগ সরকারের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি গড়ে তোলেন এই সিন্ডিকেট।
শেখ হাসিনা সরকারের মতোই নামমাত্র নির্বাচন দিয়ে চতুর্থবারের মতোন নির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। হন টানা তিনবারের সভাপতিও। আগের নির্বাচনগুলোর মতো চলতি বছরের ২ মার্চ অনুষ্ঠিত হওয়া নির্বাচনটির বিরুদ্ধেও রয়েছে কারচুপির অভিযোগ। বিপক্ষ মতের হওয়ায় লাইসেন্স ধারী ২ শতাধিক এজেন্সিকে দেয়া হয়নি ভোটার হবার সুযোগ।
অ্যারোড্রম বাংলাদেশ লিমিটেডের এমডি মো. নুরুল আলম বলেন, ‘দুই শতাধিক লাইসেন্সধারীকে সে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে দেয়নি। পরবর্তী পর্যায়ে জাল ভোট, যারা বিদেশী ছিল, যে সদস্যরা মারা গেছেন এনাদের কার্ড পকেটে রেখে সেগুলো প্রয়োগ করেছে। প্রমাণও আছে, আমরা হাতেনাতেও ধরেছিলাম।’
প্রথম দুবছর মহাসচিব ও পরের ৬ বছর সভাপতি মোট ৮ বছরে তসলিম কিছু এজেন্সিকে নিয়ে গড়ে তোলেন নিজস্ব বলয়। বলয়ের এজেন্সিদের সুবিধা দিতে তিনি চলতি বছর ৫৬টি লাইসেন্স এর মাধ্যমে ২০০০ কোটার প্রবর্তন করেন। অথচ ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীনে লাইসেন্স প্রাপ্ত এজেন্সির সংখ্যা ১ হাজারের বেশি।
পরে প্রতিবাদের মুখে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে না পারলেও এক লাইসেন্সের সর্বনিম্ন হজযাত্রীর কোটা ১০০ থেকে ২৫০ তে উন্নীত করেন। কোটা পূরণ করতে না পারায় কয়েকটি এজেন্সি মিলে একটি লাইসেন্সের অধীনে যাত্রী পাঠাতে হয়েছে। যার দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে যাত্রীদেরই।
এস আর ট্রেড ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আলী বলেন, ২০০০ হাজী করে নিয়ে আমাদের ৫৬টি এজেন্সির যে সিণ্ডিকেট তৈরির পরিকল্পনা করেছেন বর্তমান কমিটির পলাতক মহাসচিব।’
এমন সিন্ডিকেটের কারণে কাজের সুযোগ না পেয়ে অনেক এজেন্সি টানছে লোকসানের বোঝা। মত পার্থক্য হলেই এজেন্সির বিরুদ্ধে ধর্ম মন্ত্রণালয়কে দিয়ে কারণ দর্শানো নোটিশ, লাইসেন্স ফ্রিজ করা ও লাইসেন্স বাতিলের মতো ঘটনা ছিলো অহরহ। এখন টিভিকে সাক্ষাৎকার দেয়ায় তসলিম ধর্ম মন্ত্রণালয়কে দিয়ে করেছিলেন হয়রানি। এমন অভিযোগ এই এজেন্সি মালিকের।
বীথি ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস এর স্বত্বাধিকারী মোশাররফ হোসাইন বলেন, ‘আমি এখন টিভিতে একটা সাক্ষাৎকার দিয়েছিলাম। শুধু এটুকু বলেছি যে হজযাত্রীদের যদি প্রতি ওয়াক্তের নামাজ হারামে এসে পড়তে হয়ে তাহলে নিজের গাড়িতে করে আসতে হবে। সে ক্ষেত্রে খরচ কিছুটা বেড়ে যাবে। শুধু এটুকু বলেছিলাম। এটার জন্য আমাকে মন্ত্রণালয় থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে।’
নির্বাহী কমিটির সভাতেও স্বৈরাচারী আচরণের অভিযোগ উঠে এসেছে তসলিমের বিরুদ্ধে। চাপ প্রয়োগ করে প্রতিষ্ঠা করতেন নিজের মত।
হাবের কার্যনির্বাহী সদস্য আকবর আলী বলেন, ‘উনি আসলে ওনার মতো করেই চলতেন। নির্বাচনের সময় শুধু আমাদের সাথে। কারণে বাকি সদস্য ছাড়া তো প্রেসিডেন্ট হওয়া যায় না। তো নির্বাচন শেষ হয়ে গেলে অনেক সদস্যেরই আর মূল্যায়ন হতো না।’
হজের প্যাকেজের অতিরিক্ত বিমান ভাড়ার হোতাও এই তসলিম। ২০২২ পর্যন্ত বাংলাদেশ বিমান ও সৌদিয়া এয়ারলাইন্স এই দুটি রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী সংস্থা ৫০ শতাংশ করে হজযাত্রী পরিবহন করতো। ২০২৩ সালে হজযাত্রী পরিবহনে আসে নতুন আরেকটি এয়ারলাইন্স ফ্লাইনাস। আর সেবছরই বিমান ভাড়া বেড়ে যায় ৫৭ হাজার টাকা।
ক্ষমতাসীন সরকারের প্রভাব খাটিয়ে ফ্লাইনাসকে থার্ড ক্যারিয়ার হিসেবে হজযাত্রী পরিবহনে যুক্ত করান তসলিম। বাংলাদেশে এয়ারলাইন্সটি এজেন্ট ডাইনেস্টি ট্রাভেলস। যার স্বত্বাধিকারী তসলিম নিজেই। আবার হাবের সভাপতি হিসেবে তিনি ছিলেন হজের বিমান ভাড়া নির্ধারণ কমিটির সদস্য। আর সেকারণেই আগের বছর ১ লাখ ৪০ হাজার টাকার বিমান ভাড়া পরের বছর হয়ে যায় ১ লাখ ৯৭ হাজার টাকা।
নিয়ম অনুযায়ী টিকিটের টাকা সরাসরি এয়ারলাইন্সকে পরিশোধ করার কথা থাকলেও এখানেও কারসাজি করেন তসলিম। প্রভাব খাটিয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি ইস্যু করে ফ্লাইনাসের টিকিটের টাকা তার প্রতিষ্ঠান ডাইনেস্টি ট্রাভেলস এ জমা দেবার নির্দেশ দেন। ২০২৩ সালে ফ্লাইনাসের মাধ্যমে ২০,২৩৬ ও চলতি বছর ১৪,১৮৬ হজযাত্রী পরিবহণ করে শতকোটি টাকা ঢোকান নিজের পকেটে।
শুধু তাই নয় চলতি বছর বেসরকারি হজযাত্রীদের ভিসা দেরিতে করিয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ১৬৮৩ যাত্রীর বুকিং কম করান। নিয়ম ভেঙ্গে সেই যাত্রীদের নিজের এয়ারলাইন্স ফ্লাইনাসে নিয়ে নেন। এতে করে বিমানের ৯ টি ফ্লাইট বাতিল করতে হয়। এই ঘটনায় বিমান ধর্ম মন্ত্রণালয়কে ক্ষতিপূরণ চেয়ে চিঠিও দেয়া হয়েছিলো।
ধর্ম উপদেষ্টা জানান, দায়িত্ব নেবার পর হজের সিন্ডিকেট ও হাবের উপর রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর বিষয়টি তার নজরে এসেছে। আশ্বাস দেন, সব সিন্ডিকেট ভেঙ্গে যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনা হবে হজের খরচ।
ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ. ফ. ম. খালিদ হোসেন বলেন, ‘অতীতে সিণ্ডিকেশন ছিল। অতীতে ব্যক্তি বিশেষের প্রভাবের কারণে ভাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন কেউ রাজনৈতিক কারণে প্রভাব খাটিয়ে ফ্লাইনাসে যদি বেশি যাত্রী বহন করে, এমন একটা অভিযোগ আছে। বাংলাদেশ বিমানকে বসিয়ে রেখে, এগুলো আমরা খতিয়ে দেখবো।’
তিনি বলেন, বিমান ও ঘর ভাড়া যদি কমাতে পারি, খাবারের টাকা যদি মাইনাস করতে পারি তাহলে অ্যামাউন্ট কমে যাবে।’
এজেন্সি গুলো মনে করে, সিন্ডিকেট ভাঙ্গলে ও বিমান ভাড়া যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে এনে কমপক্ষে ১ লাখ টাকা কমানোর সুযোগ আছে হজের প্যাকেজে।