দমকা বাতাসে ঝরে যাওয়া পাতার মতোই যেন খসে পড়েছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্তারা। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে ভিসি, প্রক্টর, প্রভোস্টসহ একের পর এক প্রশাসনিক কর্মকর্তার পদত্যাগে, তাসের ঘরের মতো নিমিষেই ভেঙে গিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রশাসনিক কার্যক্রম।
ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাত ধরে শুরু হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়টিকে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয়েছে স্থিতিশীল রাখার চেষ্টায়। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, প্রতিষ্ঠাকাল থেকে উপাচার্যদের বেরোবি ক্যাম্পাসে না থাকা, সদ্য সাবেক সরকার দলীয় অনুগতদের পদে বসানো ছিল অলিখিত নিয়ম। এছাড়া শিক্ষার্থী কিংবা কর্মচারীদের দফায় দফায় আন্দোলনে ব্যাহত হয়েছে শিক্ষা কার্যক্রম। চলতি বছরের পাঁচ আগস্টের পর পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন অন্তত ৪০ জন প্রশাসনিক কর্মকর্তা। এমন নানা সংকটে ১৮ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় খুললেও শুরু হয়নি শিক্ষা কার্যক্রম। প্রায় দুই মাসেও শেষ করা যায়নি প্রথম বর্ষের ভর্তি কার্যক্রমও।
একজন শিক্ষার্থী বলেন, 'সবাই গণহারে পদত্যাগ করেছে, ফলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের যে অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম ভেঙ্গে পড়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীবান্ধব একজন ভিসি দরকার।'
ছয়টি অনুষদের আওতায় ২২টি বিভাগে শিক্ষা কার্যক্রম চললেও ২১টি বিষয়ই চালু হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শুরুর সময়। ২০১৭ সালে প্রায় শতকোটি টাকার একটি অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হলেও তৎকালীন উপাচার্যের দুর্নীতির দায়ে সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। তাই বিগত দেড় দশকে গবেষণা, অবকাঠামো, শিক্ষার মানে ক্রমেই পেছনের সারিতেই থাকতে হয়েছে উত্তরের এই বৃহৎ বিদ্যাপিটকে। এজন্য আরোপিত নিয়ম আর মেরুদণ্ডহীন প্রশাসনকে দুষছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। তাই উচ্চ শিক্ষাকে নির্বিঘ্ন করতে প্রয়োজনে আইনের সংস্কার চান এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক ওমর ফারুক বলেন, 'যোগ্যতার ভিত্তিতে যারা প্রাপ্য, যারা কাজ করতে পারবেন সেরকম উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য নিয়োগ দেয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ীভাবে শিক্ষার পরিবেশ সুনিশ্চিত করা খুব জরুরি।'
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক তাবিউর রহমান বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন আইনের সংস্কার করতে হবে, তেমনি আইনটা পালনও করতে হবে, তাহলেই হয়তো আমাদের এ জায়গা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।'
বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলছেন, উপাচার্য নিয়োগ হলে স্থবির হওয়া কাজের গতি ফিরবে। তবে কবে নাগাদ ভর্তিসহ স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু হবে এমন উত্তর নেই কারও কাছে।
মোহাম্মদ আলী বলেন, 'খুব দ্রুত যদি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন উপাচার্য নিয়োগ দেয়া হয় এবং তিনি এই প্রশাসনিক পদগুলোতে যোগ্য ব্যক্তিদের দায়িত্ব দেবেন। এবং খুব দ্রুতই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম চলবে।'
এ বিশ্ববিদ্যালয়ের হাত ধরে উত্তরের শিক্ষা বিস্তার ও কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে সুফল পাওয়ার আশায় কোটি মানুষ বুক বাধলেও বেরোবি যেন অভিভাবকহীন এক দুঃখী ক্যাম্পাসের উপাখ্যান।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেড় দশকে কখনও ভিসি বিরোধী আন্দোলন, কখনো বা রাজনৈতিক কারণে ক্লাস বন্ধ রেখে স্থবির করা হয়েছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর সদ্য বিদায়ী আওয়ামী সরকারের অনুগত ও দলীয় পরিচয় বিবেচনায় প্রশাসনিক পদে নিয়োগ পাওয়া এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের পদত্যাগের পর সৃষ্ট হয়েছে নতুন অচলায়তন। তাই রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বাজেট বৈষম্য দূর, গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি আর সত্যিকারের যোগ্যদের প্রশাসনিক পদায়ন হোক, এমন আশা মোটেও উচ্চাভিলাষ নয়, বলছেন এ অঙ্গনের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।