দেশে এখন

যেভাবে জোগাড় হলো বাবরের এভারেস্ট জয়ের অর্থ

ছোটবেলা থেকে পাহাড় টানতো চট্টগ্রামের ছেলে এভারেস্ট জয়ী পঞ্চম বাংলাদেশি বাবর আলীকে। বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্ঘ জয়ের নেশার কাছে তার সবকিছুই যেনো ম্লান হয়ে গিয়েছিল। কোন কিছুই দমাতে পারেনি তাকে। তাই তো পবর্তারোহনের জন্য ছুটি না পাওয়ায় ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার মোটা বেতনের চাকরিও ছেড়ে দিতে কার্পণ্য করেন নি। সবকিছু ছেড়ে পর্বতারোহনে নিজেকে উৎসর্গ করেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করা পেশায় চিকিৎসক বাবর আলী।

দীর্ঘ নয় বছরে বাংলাদেশ, ভারত, নেপালের আট থেকে ২০ হাজার ফুট উচ্চতার অসংখ্য পবর্তে চড়ে ধাপে ধাপে নিজেকে প্রস্তুত করেন বাবর আলী। এরপর অবশেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। রোববার সকালে পঞ্চম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্টের চূড়ায় লাল সবুজের পতাকা উড়ান বাবার আলী।

শুধু নিজ সংগঠন ভাটিক্যাল ড্রিমার্সই নয় বেজ ক্যাম্প ৪ এ পৌঁছার পর বাবরের সবোর্চ্চ পর্বত শিখর জয়ের অপেক্ষায় নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন তার স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা। এই স্বপ্ন জয়ে জড়িত ছিলেন অসংখ্য মানুষ। যার মানসিক ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে এগিয়ে এসেছেন এই অভিযানে।

ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স এর সাবেক সভাপতি শিহাব উদ্দিন রিয়াদ বলেন, 'গতকাল রাত থেকে বাংলাদেশের অনেক মানুষ ঘুমাতে পারে নি। সকালে যখন খবরটা পেলাম, অবিশ্বাস্য ছিল! বলতে গেলে আমরা শুধু কেঁদেছি। এই জয়ের অর্থ ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে হওয়ায় বাংলাদেশের অনেক মানুষ এরমধ্যে যুক্ত হতে পেরেছে। আর এ কারণে এই পর্বতজয়ের অনুভূতিটা আসলে অনেক বেশি।'

এভারেস্ট জয়ের সেই গল্পের কথা জানান বাবরের স্বপ্ন পূরণের সারথী এই অভিযানের প্রধান সমন্বয়ক ও ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ফরহান জামানের কাছ থেকে। যিনি হিমালয়ে তিনটি পর্বত অভিযানে তার স্বপ্নের বীজ বোনার শুরু থেকে ছিলেন। নয় বছরে নেপালের আমাজন দুর্গম পর্বতে আরোহনসহ বাংলাদেশের ২০ হাজার ফিট উচ্চতার পর্বত জয় করেন বাবর।

ফরহান জামান, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স

ফরহান জামান বলেন, বাবর পর্বত আরোহনকে তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ করে নিয়েছিলেন।

২০১৪ সালে নেপালে তিনটি পর্বতে ট্র্যাকিং দিয়ে শুরু হয়েছিল বাবরের যাত্রা। যা খুব সহজ ছিল না। লম্বা সময় লেগে থাকা, অফিস থেকে ছুটি পাওয়া, প্রায় অর্ধ কোটি টাকার অর্থ সংগ্রহ। সব মিলিয়ে অনেক ধরনের প্রতিকূলতা ও চ্যালেঞ্জ জয় করেছেন বাবর।

সার্বিক প্রস্তুতি শেষে বাবর যখন পুরোপুরি প্রস্তুত, তখন তহবিল সংকটে থমকে যাওয়ার উপক্রম হয় যাত্রা। তবে প্রায় ৩০ লাখ টাকার গণতহবিল তার এই শীর্ষ পর্বতশৃঙ্ঘ জয়কে সহজ করে দেয়। সহায়তার হাত বাড়ায় অনেক কর্পোরেট গ্রুপ।

এ বিষয়ে ফরহান জামান বলেন, 'মার্চ মাসের শেষের দিকে আমরা টাকাটা যোগাড় করে ফেললাম। তারপর মার্চের ৩০ তারিখ আমরা সংবাদ সম্মেলন করে জানাই যে, আমরা এভারেস্ট জয় করতে যাচ্ছি।'

দুর্গম এ যাত্রা শুরু করার আগেও দশ লাখ টাকার ঘাটতি ছিল বলে জানান ফরহান জামান। বাবর আলীকে নেপাল পাঠিয়ে সে দায়িত্ব নিয়েছিল ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স।

বাংলাদেশ থেকে বাবর আলী নেপালের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন গত ১ এপ্রিল। প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ করে ৪ এপ্রিল কাঠমান্ডু থেকে উড়ে যান লুকলা বিমানবন্দরে। ট্র্যাকিং শুরু হয় এ দিন। এরপর পথচলা শুরু করেন এভারেস্ট বেজক্যাম্পের উদ্দেশ্যে। সেখানে পৌঁছান ১০ এপ্রিল। তবে পর্বতারোহীদের জন্য পথ প্রস্তুত না থাকায় অপেক্ষায় থাকতে হয় বাবরকে। এরমধ্যে পেছনে নেমে ছয় থেকে সাত হাজার ফুট উচ্চতার পর্বতে উঠানামা করে আবহাওয়ার সাথে খাপ খাইয়ে নেন। ১৪ মে মাঝরাতে বেজক্যাম্প থেকে বাবরের যাত্রা শুরু হয় চূড়া অভিমুখে। প্রথম দিনেই সরাসরি উঠে যান ক্যাম্প ২ -এ। পরিকল্পনা অনুযায়ী, সেখানে দুই রাত কাটিয়ে বাবর পৌঁছায় ক্যাম্প ৩ এবং ক্যাম্প ৪-এ। ২৬ হাজার ফুট উচ্চতার এই ক্যাম্পের ওপরের অংশকে বলা হয় ডেথ জোন। ১৯ মে ভোরের প্রথম আলোয় ২৯ হাজার ৩১ ফুট উচ্চতার মাউন্ট এভারেস্টের শীর্ষে বাবর উড়ান বাংলাদেশের পতাকা।

এই যাত্রা এখানেই থামবে না। বাবরের লক্ষ্য শুধু এভারেস্ট নয়, এর সঙ্গে লাগোয়া পৃথিবীর চতুর্থ শীর্ষ পর্বত লোৎসে জয় করে জুনের মাঝামাঝি দেশে ফিরবেন বাবর।

২০১০ সালের ২৩ মে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্টের শীর্ষে ওঠেন মুসা ইব্রাহীম। এরপর ২০১১ ও ২০১২ সালে দুবার এভারেস্ট জয় করেন এম এ মুহিত। প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে ২০১২ সালের ১৯ মে এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করেন নিশাত মজুমদার। একই মাসের ২৬ মে ওয়াসফিয়া নাজরীন জয় করেন এভারেস্ট। ২০১৩ সালের ২০ মে এভারেস্টজয়ী পঞ্চম বাংলাদেশি সজল খালেদ এভারেস্টের চূড়া থেকে নেমে আসার সময় মারা যান।

চট্টগ্রামের হাটহাজারীর বুড়িশ্চরে জন্ম নিয়েছিলেন চিকিৎসক এই তরুণ। চার ভাই বোনের মধ্যে সবাই স্ব স্ব পেশায় প্রতিষ্ঠিত হলেও পাহাড়প্রেমী এই যুবক এখনও সংসারী হন নি। সরকারি মুসলিম হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক , ইস্পাহানি স্কুল এন্ড কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করলেও পর্বতের নেশা ডাক্তারি পেশায়ও থিতু হতে পারে নি বাবর আলীকে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৫১ তম ব্যাচের শিক্ষার্থ বাবর আলী।

এসএসএস

এই সম্পর্কিত অন্যান্য খবর