রুমা। বাবার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হওয়া এক নারী। তারা ছয় ভাই-বোন। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর পৈতৃক সম্পত্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে ভাইদের সম্মতি ছিল না। উল্টো রুমা যাতে তার প্রাপ্য অংশ না পায় সে চেষ্টা করা হয়।
সম্পত্তি ভাগের বিষয়ে রুমা বলেন, 'আব্বু যখন ছিল, তখন সে বলে দিয়েছে যে ছয়টা ফ্ল্যাট সমানভাবে ভাগ হবে। একটা ছেলের সমান যেহেতু দুইজন মেয়ে। সে হিসাবে মেয়ে পুরো একটা ফ্ল্যাট পাবে না। সে জন্য অন্য জায়গায় ভাইদের কম নিতে বলেছিল আব্বু।'
বাবার বলে যাওয়ার পরও রুমাকে সম্পত্তি দিতে নারাজ তার ভাইয়েরা। রুমা বলেন, 'আসলে আমার ভাইয়েরা যেগুলো রেডি ফ্ল্যাট আছে, যেগুলোর দাম বেশি- সেগুলো নিতে চাচ্ছে। আইন অনুযায়ী যতটুকু পাওয়া যায়, সে হিসাবে আমি নিতে রাজি হয়েছি। সেভাবেও আমার ভাইয়েরা আমাকে দিতে চাচ্ছে না।'
প্রতিবেদকের সঙ্গে ভুক্তোভোগী রুমা। ছবি: এখন টিভি
এতকিছুর পরও কী তিনি আইনের শরনাপন্ন হবেন না?
এমন প্রশ্নে রুমা বলেন, 'মামলা কয়েকবার করতে চেয়েছি আমি। কিন্তু মামলা করতে গেলে দেখা যায় প্রত্যেকবার কিছু ফি দিতে হবে, তারিখের পর তারিখ পড়বে। এতে অনেক খরচ হয়ে যাবে। সেজন্য মামলা করা হয়নি।'
নিজের পৈতৃক সম্পত্তি থেকে এমন বঞ্চিত হওয়ার গল্প শুধু রুমার একার নয়। গ্রামীণ-শহুরে সব জায়গায় তারা বিদ্যমান। মুসলিম নারীদের সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার দেয়া হলেও নেই পুরুষ এবং নারীর সমান ভাগ। খ্রিষ্টান ধর্মে সমান ভাগের কথা বলা হলেও হিন্দু নারীরা পৈতৃক সম্পত্তির উত্তরাধিকারই নন।
এক্ষেত্রে ধর্মের উত্তরাধিকার আইনগুলো এক না হওয়ায় সাংবিধানিক অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে বৈষম্য থেকেই যাচ্ছে। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১ অনুযায়ী, উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে সমান অধিকার না দিয়ে, 'উত্তরাধিকার' সূত্রে পাওয়া এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পত্তিতে সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে, যা নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক। কেন এই বিভেদ?
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান। ছবি: এখন টিভি
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, 'সম্পত্তি শব্দটা যখন আসে, তখন সবাই তা ধরে রাখার চেষ্টা করে। তখন সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হয় হচ্ছে বোন বা নারী। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীরা যেহেতু একদম পশ্চাৎ অবস্থানে আছে, তাদের এগিয়ে আনতে হলে সম্পত্তির খুবই দরকার। কারণ অর্থনৈতিক মুক্তি না হলে কখনও কেউ আগাতে পারে না।'
এক্ষেত্রে ধর্মীয় আইনের পাশাপাশি প্রয়োজন সার্বজনীন দেওয়ানী আইন। যার ভিত্তিতে নারী বা পুরুষ যেকোনো বঞ্চিত উত্তরাধীকারী তার আইনি প্রতিকার চাওয়ার ভিত্তি পাবেন।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট মলয় সাহা বলেন, 'কালের বিবর্তনে, সময়ের প্রয়োজনে এখন একটা পর্যায়ে আসছে যেখান থেকে কোনো সমাধান করা গেলে সম্পত্তিগুলো বিলি বন্দোবস্ত করা সম্ভব।'
সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হলেও নারীদের আদালতে যাওয়ার নজির তুলনামূলক কম। যার অন্যতম কারণ আইনের দীর্ঘসূত্রিতা ও জটিলতা।
এছাড়াও নারীদের শিক্ষার হার বাড়ানো, নারী নিজের অধিকার নিয়ে সোচ্চার থাকলে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার হার কমানো সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমীন। ছবি: এখন টিভি
ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমীন বলেন, 'অবশ্যই নারী যখন বেশি শিক্ষিত হবে, নিজের একটা মূল্য তৈরি করবে। তখন সে নারী নিজের অধিকার যেভাবে বুঝে নিতে পারবে, অন্য কেউ সেভাবে পারবে না। একজন নারী যিনি শিক্ষার সুযোগ, কাজ করার সুযোগ পাননি। যাকে একেবারেই নির্ভরশীল হতে হচ্ছে পরিবারের পুরুষদের ওপর, তার জন্য সম্পত্তির অধিকার আদায় করার বিষয়টা আরও বেশি কঠিন ও জটিল হয়ে যায়।'
নারী ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন রিমি। ছবি: এখন টিভি
কিন্তু কেনো এখনও সম্পত্তিতে সম-অধিকার আইন চালু হলো না কিংবা কবে নাগাদ চালু করা সম্ভব হবে সেই প্রশ্নের উত্তরে নারী ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন রিমি বলেন, 'আমি প্রথমে বলবো সমাজ এখনও সেভাবে তৈরি হয়নি। নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে এর কিছু একটা হবে। এটা তো রাতারাতি পরিবর্তন হওয়া সম্ভব না। যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে। তা নিয়ে আমাদের কিছু বলা বা করাটা সহজসাধ্য ব্যাপার না।'
আজকের নারী দিবসে টেলিভিশন, পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও বিলবোর্ডজুড়ে সারাদিন হাজারও এগিয়ে যাওয়া নারীর গল্প আমার সামনে পড়বে। কিন্তু এর আড়ালে নিজের ঘরেই যে আমাদের নারীরা কতটা বঞ্চিত, তাদের সংখ্যা যে কতটা দীর্ঘ- সেই হিসাব কে কবে রেখেছে?