সংস্কৃতি ও বিনোদন
দেশে এখন
0

রিকশার ঐতিহ্য রক্ষায় রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রণোদনার দাবি

শাহনুর শাকিব

বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ এখন ঢাকার রিকশা ও রিকশাচিত্র। মেট্রোরেল চালুসহ আধুনিক ঢাকায় হয়েছে ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেসওয়ে। নগরীর সব সড়কে চলার অনুমতি নেই এই বাহনটির। তবুও নাগরিক চলাচলের বহুবিধ প্রয়োজন অবাধে মিটিয়ে চলছে রিকশা।

তিন চাকার এই যান শুধু কি যাত্রীদেরই বয়ে নিয়ে যায়? নাকি শহরের অলি-গলি থেকে সড়ক, চলার পথে পথে সঙ্গে নিয়ে এগোয় সমকালীন জীবনের নানা গল্প? রাজধানীতে ১০০ বছর ধরে দাপিয়ে বেড়ানো এই যানের সঙ্গে দেশের ঐতিহ্যের নানা চিত্র জুড়ে নেয়ার বয়সও কম হয়নি। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে জনপ্রিয় হওয়া রিকশাচিত্র এখনও চোখ জুড়ায় পথচারীদের।

বাহারি রঙ আর মোটিফের মাধ্যমে রিকশাচিত্রে তুলে ধরা হয় আবহমান বাংলার সমসাময়িক নানা চিত্র। ময়ুর, হাতি, বাঘ, ফুল, পাখি, লতাপাতাসহ নানা প্রাণীর অবয়ব ফুটে ওঠে রিকশাচিত্রে। আবার কখনও গ্রামবাংলার দৃশ্য কখনো সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের মুখচিত্রও নজর কাড়ে।

রিকশার এই ঐতিহ্যের মুকুটে যুক্ত হলো নতুন এক পালক। ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অপরিমেয় বা বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে নাম লিখিয়েছে ঢাকার রিকশাচিত্র।

ইউনেস্কোর বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আন্তঃসরকার কমিটির ১৮তম অধিবেশনে এই ঘোষণা দেয়া হয়। এর আগে ২০০৮ সালে স্বীকৃতি পায় বাউলগান, আর ২০১৩ সালে জামদানি বুননশিল্প। ২০১৬ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রা ও ২০১৭ সালে শীতলপাটি বুননশিল্পও জায়গা করে নেয় বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায়।

আদিরূপ হারাতে বসা এই রিকশাচিত্র যে কয়েকজনের হাত ধরে এখনও টিকে আছে তাদেরই একজন সৈয়দ আহমেদ হোসেন। দেশে বিদেশে বিভিন্ন সময় নানা মোটিফ আর রঙ দিয়ে মন কেড়েছেন। দেশের বাইরে অসংখ্যবার করেছেন রিকশাচিত্র প্রদর্শনী। ইউনেস্কোর স্বীকৃতিতে তাই আবেগাপ্লুত তিনি। ঢাকার রিকশাচিত্র শিল্প টিকিয়ে রাখতে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেয়ার দাবিও তার কণ্ঠে।

রিকশাচিত্র শিল্পী সৈয়দ আহমেদ হোসেন।

রিকশাচিত্র শিল্পী সৈয়দ আহমেদ হোসেন বলেন, 'সরকার পুরান ঢাকায় কিছু রিকশা রাখার অনুমতি দেয়, যে কিছু রিকশা ওখানে থাকবে। কিন্তু সেগুলো পুরাতন হয়ে গেলে নতুনভাবে চিত্র করার অনুমতি দেয়। এতে আমরা কাজ করর সুযোগ পেতাম, বিদেশিরাও এসে ঘুরে দেখতো এসব।'

ষাটের দশক থেকে রংতুলির আঁকিবুকিতে ব্যস্ত হানিফ পাপ্পু। তার সুনিপুণ তুলির ছোঁয়ায় এই ঐতিহ্য ছাড়িয়েছে দেশের গণ্ডি। দশফুট বাই ছয় ফুটের একটি ঘরে বসে আঁকা বাহারি রিকশাচিত্রকর্ম পেয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। তাই আনন্দটাও বাঁধভাঙা। তার চাওয়া নতুন পৃষ্ঠপোষকতায় এই শিল্পে এগিয়ে আসুক নতুন প্রজন্ম।

রিকশা চিত্রশিল্পী হানিফ পাপ্পু বলেন, 'আন্তর্জাতিক একটি স্বীকৃতি পেয়েছে এ শিল্প এখন সে বিষয়টি মাথায় রেখে আমাদের দিকে নজর দেওয়া উচিত সরকারের। সরকার যদি আমাদের সাহায্য করে তাহলে সে সহযোগিতায় এ শিল্পকে আমরা ভালোভাবে তুলে ধরতে পারব। ফলে আমাদের এখানে প্রশিক্ষণ দিয়ে নানা জায়গায় কাজের জন্য পাঠাতে পারব।

রিকশা চিত্রশিল্পী হানিফ পাপ্পু।

রিকশাচিত্রের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে বাংলাদেশের রিকশাশিল্প নিয়ে নানা তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয় ইউনেস্কোর অধিবেশনে। আর এর পেছনে নিরলস কাজ করেছেন বাংলা একাডেমির ফোকলোর বিভাগের পরিচালক। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর এমন অর্জনে উচ্ছ্বসিত তিনি।

তার মতে, রিকশার এই ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রণোদনা। পাশাপাশি নগরের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্টদের রিকশাচিত্রের ব্যবহার বাড়ানোর তাগিদ দেন তিনি।

বাংলা একাডেমি ফোকলোর বিভাগের পরিচালক ড. আমিনুর রহমান সুলতান বলেন, 'জয়ধ্বনি তখনই স্বার্থক হবে যখন রিকশাচিত্রকে একটি সুরক্ষা দেয়া যাবে। ঢাকাতে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে সে উদ্যোগ নিতে পারে।'

রিকশার মতো বহমান এই ক্যানভাস শুধু যাতায়াতের মাধ্যম নয়, বরং দেশের ঐতিহ্যের নানা গল্প নিয়ে ছুটে চলবে পথে-প্রান্তরে। ইউনেস্কোর স্বীকৃতি এই রিকশাচিত্রকে আরো সুরক্ষিত করবে আগামীর জন্য।

এসএস