সম্পর্কের মধুচন্দ্রিমায় অমাবশ্যা নেমে আসার লগ্নের কোনো পূর্বাভাস থাকে না। কখনও কখনও সাংসারিক আবহাওয়ার নিম্নচাপ তৈরি হয়, আবার মেঘ কেটে রোদ উঠে, জোছনায় ভরে আকাশ। কিন্তু কোনো কোনো নিম্নচাপের ঘূর্ণি দুটি মন, দুটি মানুষকে দুই দ্বীপে উড়িয়ে নেয়। ভালোবাসার পূর্ণিমায় অনন্তকালের অমাবশ্যা নেমে আসে। যে মানুষের হাতে হাত রেখে কথা ছিল পাড়ি দেবো সাত জন্ম, সেই মানুষের সঙ্গে এক জন্মটাই পুরোপুরি কাটানো হয় না।
এক নারী বলেন, 'আমার পরিবারে যখন ঝামেলা শুরু হয়ে গেলো। তখন মনে হলো, চলে আসি। কিন্তু সামাাজিক দায়বদ্ধতা বিবেচনা করে আসতে পারিনি। কেননা, আমার পরিবারকে নানানভাবে আজেবাজে কথা বলবে। এসব ভেবেই, এতো টর্চারের পরও আমি কখনও আসতে চাইনি। কিন্তু সবকিছুর তো সীমা থাকে, পরে আর সহ্য করতে পারিনি।'
সম্পর্কে যে ধূলির ঘূর্ণি তৈরি হয়, সেই ধূলিতে থাকে অবিশ্বাস, সংশয়, অশ্রদ্ধা এবং তৃতীয়পক্ষের প্ররোচণা। অস্বাস্থ্যকর ধূলিময় বসত তখন আর ভালোবাসার বসতি বা প্রণয় থাকে না।
এক পুরুষ বলেন, 'বিয়ে এখন শোঅফ হয়ে গেছে। একটা বিয়েতে ৭ থেকে ৮টি প্রোগ্রাম হয়। আর এসবের মাঝে অনেক চাহিদা তৈরি হয়। আবার কাবিন নিয়ে বাড়াবাড়ি হচ্ছে। সবমিলিয়ে বিয়ে আর স্বাভাবিক পর্যায়ে নেই।'
'বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স' অনুযায়ী ২০১১ সালে দেশে তালাকের স্থুলহার ছিল প্রতি হাজারে ০.৭ যা ২০২১ সালে বেড়ে হয়েছে প্রতি হাজারে ১.৪। এর মধ্যে গ্রামে তালাকের প্রবণতা বেড়েছে বেশি। গত বছর গ্রামাঞ্চলে প্রতি হাজারে ১ দশমিক ৫টি আর শহরে হাজারে একটি বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে।
এছাড়া রাজধানীতে প্রতিদিন গড়ে সংসার ভাঙছে ৫০টির বেশি। ২০২৩ সালে ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৭ হাজার ৩০৬টি এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৬ হাজার ৩৯৯টি বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২০ সালে করোনা মহামারির পরপরই বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা বাড়ে আগের থেকেও বেশি। নারীরা কখনও কখনও সংসারে নিজের মর্যাদা না পেয়ে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। অপরদিকে দেনমোহরের লেনদেনে নিপীড়িত হয়েও পুরুষরা বিবাহ বিচ্ছেদের দিকে ঝুঁকছেন বলে মনে করা হয়।
বাংলাদেশে বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শেখ কানিজ ফাতেমা বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীরাই বেশি আসে। একটা বিষয় নারী মানেই ভুক্তভোগী, তার পাশে আছি বিষয়টি এমন হয়ে গেছে। কিন্তু পুরুষের সংখ্যাও কম নয়, পুরুষও আসছে। নারীরা হয়তো যৌতুকের কারণে ডিভোর্স নিচ্ছে। পুরুষদের কাছে আবার বেশি ডিমান্ড করা হচ্ছে।’
কাজী মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘শরীয়াতের ভাষায় নারী-পুরুষ দেনমোহর নির্ধারণ করবে। একজন পুরুষ তার সার্মথ্য অনুযায়ী মোহর ঠিক করতে পারে। কিন্তু এখন পরিবারের পক্ষ থেকে ৫ থেকে ১০ লাখ দেনমোহর ঠিক করা হচ্ছে।’
এছাড়া সমাজে সহিষ্ণুতা হ্রাস পাওয়ায় বিবাহ বিচ্ছেদের হার বেশি বলে মনে করেন সমাজ বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশে ডিভোর্সের হার কত ২০২৫
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. নেহাল করিম বলেন, ‘নারী নাকি পুরুষরা বেশি বিচ্ছেদ চায়, এটি একটি বিষয়। নারীরা যদি চায়, তাহলে বুঝতে হবে তারা স্বাবলম্বী হয়েছে। সে কারণে তাদের হারানোর কিছু নেই, একটা জেদ বা আত্মসম্মান থাকে তো। এ কারণেও বিচ্ছেদ বেড়েছে। এর পেছনে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণও আছে।
নগর বা গ্রামের যাপন, কোথাও আর একলার ঘানি টেনে নেওয়ার জীবন নেই। দুইয়ে মিলে সংসারের চাহিদা মেটাতে হয়। কোনো কোনো দম্পতির সংসারের চৌহুদ্দিটা বড় হয়। তাদের ওপর অন্যদের নির্ভরতা থাকে। যা কখনও কখনও স্বামী-স্ত্রী উভয়ের ওপরই বাড়তি চাপ তৈরি করে। সেই চাপ, ব্যক্তিত্বের সাংঘর্ষিক অবস্থান, পছন্দ-অপছন্দের তালিকা বড় হতে থাকা এবং কখনও কখনও জৈবিক চাহিদার হিসেব-নিকেষ সম্পর্কে বিচ্ছেদের পর্দা নামিয়ে দেয়। তবে টানাপোড়নের সময় স্বামী-স্ত্রী যে মানসিক বিপর্যস্ততার মধ্যে থাকে, সে সময় তাদের মনের যত্ন নেয়া দরকার বলে মনে করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক (সাইকিয়াট্রি) ডা. মেখলা সরকার।
ঢাকায় বিবাহ বিচ্ছেদ বৃদ্ধি সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর - Important questions and answers regarding the increase in divorce in Dhaka (FAQ)
প্রশ্ন: ঢাকায় দৈনিক গড়ে কতগুলো বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে?
উত্তর: বিভিন্ন রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকায় দৈনিক গড়ে ৫০টির বেশি (কোনো কোনো রিপোর্টে প্রতি ৪০ মিনিটে ১টি) বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়ছে।
প্রশ্ন: বিবাহ বিচ্ছেদের হার কেন বাড়ছে?
উত্তর: প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—নারীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ন, সহনশীলতার অভাব, পারিবারিক সহিংসতা, পরকীয়া সম্পর্ক, এবং একক পরিবারে দাম্পত্য চাপ বৃদ্ধি।
প্রশ্ন: বেশিরভাগ বিচ্ছেদের আবেদন স্বামী নাকি স্ত্রীর পক্ষ থেকে আসছে?
উত্তর: অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্ত্রীর পক্ষ থেকে বিচ্ছেদের আবেদন বেশি আসছে (বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী ৭০% এর বেশি), যা নারীর সচেতনতা বৃদ্ধি নির্দেশ করে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ডিভোর্স কোন শহরে হয়?
উত্তর: পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকা শহরেই বিবাহ বিচ্ছেদের হার এবং আবেদনের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
প্রশ্ন: ঢাকায় বিচ্ছেদের প্রধান দুটি কারণ কি?
উত্তর: প্রধান দুটি কারণ হলো—পারিবারিক কলহ ও মানসিক নির্যাতন এবং স্বামীর অর্থনৈতিক অক্ষমতা বা স্ত্রীর আর্থিক স্বাধীনতা।
প্রশ্ন: বিবাহ বিচ্ছেদ কী শুধু শহরেই বাড়ছে?
উত্তর: না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS) এর তথ্য অনুযায়ী, যদিও শহরে সংখ্যা বেশি, তবে গ্রামাঞ্চলেও বিবাহ বিচ্ছেদের প্রবণতা লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে।
প্রশ্ন: বিবাহ বিচ্ছেদের পর শিশুদের উপর কেমন প্রভাব পড়ে?
উত্তর: বিচ্ছেদের ফলে শিশুরা মানসিক অস্থিরতা, নিরাপত্তাহীনতা, পড়ালেখায় মনোযোগের অভাব এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মতো নেতিবাচক প্রভাবে ভোগে।
প্রশ্ন: পরকীয়া সম্পর্ক বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে কতটা দায়ী?
উত্তর: আধুনিক যোগাযোগ মাধ্যমের সহজলভ্যতার কারণে পরকীয়া সম্পর্ক বৃদ্ধি পাওয়ায়, এটি বর্তমানে ঢাকা শহরে বিবাহ বিচ্ছেদের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
প্রশ্ন: পারিবারিক সহিংসতা কি এখনও বিচ্ছেদের একটি কারণ?
উত্তর: হ্যাঁ, যৌতুক, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বা সহিংসতা এখনও বহু সংসার ভাঙার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
প্রশ্ন: বিবাহ বিচ্ছেদের হার কমাতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?
উত্তর: পারিবারিক কাউন্সেলিং সেন্টার স্থাপন করা, বিবাহপূর্ব কাউন্সেলিং বাধ্যতামূলক করা, এবং স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মধ্যে সহনশীলতা বাড়াতে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
প্রশ্ন: ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (DNCC) না দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (DSCC) – কোথায় বেশি ডিভোর্স হয়?
উত্তর: সাধারণত ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (DSCC) এর আওতাভুক্ত এলাকায় বিচ্ছেদের সংখ্যা সামান্য বেশি থাকে।
প্রশ্ন: কম বয়সে বিয়ে কি ডিভোর্সের হার বাড়াতে সাহায্য করে?
উত্তর: হ্যাঁ, বাল্যবিবাহের ফলে অপরিণত বয়সে দাম্পত্য জীবন শুরু হওয়ায় পারস্পরিক বোঝাপড়ার অভাব থাকে, যা বিচ্ছেদের ঝুঁকি বাড়ায়।
প্রশ্ন: আইনগতভাবে বিবাহ বিচ্ছেদের প্রক্রিয়া কী?
উত্তর: প্রথমে নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ (সিটি কর্পোরেশন/ইউনিয়ন পরিষদ) বরাবর আবেদন জমা দিতে হয়। এরপর উভয় পক্ষকে নিয়ে কয়েক ধাপে সমঝোতার চেষ্টা করা হয়, যা ব্যর্থ হলে বিচ্ছেদ কার্যকর হয়।
প্রশ্ন: বিচ্ছেদের আবেদন জমা দেওয়ার পর কতদিন সময় লাগে?
উত্তর: আইন অনুযায়ী, বিচ্ছেদের আবেদন জমা দেওয়ার পর তা কার্যকর হতে উভয় পক্ষকে নোটিশ পাঠানোর পর কমপক্ষে ৯০ দিন সময় লাগে।
প্রশ্ন: এই পরিসংখ্যান কি শুধু মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য?
উত্তর: না, এই পরিসংখ্যানে সকল ধর্মাবলম্বী মানুষের বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন অন্তর্ভুক্ত থাকে, তবে বাংলাদেশে মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত তথ্যই বেশি পাওয়া যায়।
