প্রভাবশালী ডিজাইনার জর্জিও আরমানি; বদলে দিয়েছেন ফ্যাশনের ব্যবসায়িক মানচিত্র

১৯৭০ এর দশকের জর্জিও আরমানি
১৯৭০ এর দশকের জর্জিও আরমানি | ছবি: সংগৃহীত
0

বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী এক ডিজাইনার জর্জিও আরমানি। তাকে বলা হয়ে থাকে ‘ইতালির ফ্যাশন সাম্রাজ্যের রাজা’। পোশাকের ডিজাইনের সঙ্গে সঙ্গে যিনি বদলে দিয়েছেন ব্যক্তিত্বের সংজ্ঞা, শৈলীর ভাষা এবং ফ্যাশন জগতের ব্যবসায়িক মানচিত্র।

দীর্ঘ পাঁচ দশকেরও বেশি সময় নিজের অস্তিত্ব কীভাবে টিকিয়ে রাখলেন আরমানি? তিনি মানতেন, স্টাইল কখনোই অতিরঞ্জন নয়, সরলতাই প্রকৃত সৌন্দর্য।

ফ্যাশন জগতে প্রবেশ

১৯৩৪ সালের ১১ জুলাই ইতালির পিয়াচেনৎসায় জন্ম নেন আরমানি। ছোটবেলায় তার মায়ের হাতে তৈরি জামাকাপড়েই ফুটে উঠতো তার স্বাভাবিক সৌন্দর্য ও স্টাইল। প্রথমে মেডিকেলে পড়ে ডাক্তার হওয়ার জন্য চেষ্টা করলেও পরে মিলান শহরে লা রিনাসেন্তে ডিপার্টমেন্ট স্টোরে চাকরি শুরু করেন। সেখান থেকেই ফ্যাশন জগতে প্রবেশ হয় আরমানির। দীর্ঘ বছর কাজ করার পর ষাটের দশকে ডিজাইনার নিনো চেরুতির সঙ্গে কাজ করেন। তারপরই পেশাগতভাবে ডিজাইন দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠা পান আরমানি।

আরমানির ডিজাইন দর্শনের সূচনা

ডিজাইন দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর সত্তরের দশকের শুরুরে দিকে এক সাধারণ জ্যাকেট খুলে ফেলেন আরমানি। ভেতর থেকে ফেলে দেন প্যাডিং, খুলে ফেলেন বোতাম, কাটিং ও সেলাই পরিবর্তন করে ফেলেন। সোয়েটারের মতো আরামদায়ক করে তুললেন ফর্মাল এক জ্যাকেটকে। এটিই ছিল তার ডিজাইন দর্শনের সূচনা। আর এ ‘ডিকনস্ট্রাকটেড’ জ্যাকেটই আরমানিকে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় করে তোলে। তার নকশা করা পোশাক পুরুষদের দেয় আরাম ও আত্মবিশ্বাস।

১৯৮২ সালে জর্জিও আরমানি |ছবি: সংগৃহীত

আরমানি যুগের শুরু

হলিউডের অভিনেতা রিচার্ড গিয়ারের সিনেমা ‘আমেরিকান গিগোলো’-তে আরমানির ডিজাইন করা স্যুট পরা দেখে হলিউডে শুরু হয় ‘আরমানি যুগ’। ১৯৮০ সালে শুরু হওয়া এ হাওয়া তাকে করেছে অনন্য।

সে বছরই যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের বার্গডর্ফ গুডম্যান স্টোরে আরমানি উইমেন্স বুটিক চালু হয়। এর দু’বছর পরই ‘জর্জিওস গর্জিয়াস স্টাইল’ শিরোনামে ম্যাগাজিনের কাভারে উঠে আসে আরমানির মুখ।

সজ্জাশৈলীর রাজা ‘কিং জর্জিও’

‘রে জর্জিও’ বা ‘কিং জর্জিও’ নামে ডাকা হতো জর্জিও আরমানিকে। মানুষ পোশাকের মাধ্যমে যেন নিজের ভেতরের আত্মবিশ্বাস ও সরলতা প্রকাশ করতে পারেন বলে মনে করতেন তিনি।

পুরুষদের জন্য কম গঠনবদ্ধ ও বেশি মানানসই পোশাক এবং নারীদের জন্য আরামদায়ক কিন্তু প্রভাবশালী পোশাক ডিজাইন করে তিনি ফ্যাশনের নতুন যুগ শুরু করেছিলেন।

এ বিষয়ে আরমানি বিভিন্ন বক্তৃতায় বলেন, ‘আমি কখনোই চমকপ্রদতা পছন্দ করিনি। বরং পোশাক থেকে কী সরানো যায়, সেই চিন্তা করেছি সব সময়।’

জীবন থেকে হারানো

আরমানির সঙ্গী ও ব্যবসায়িক অংশীদার সের্জিও গালেওত্তি তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলেন। কিন্তু ১৯৮৫ সালে গালেওত্তির আকস্মিক মৃত্যু তাকে ভেঙে দেয়। তবে এতে থেমে যাননি। একা হাতে ও পরিবারের সহায়তায় রক্ষা করেন পুরো সাম্রাজ্য।

গুচি, প্রাডা, এমনকি জন এলকানের মতো বড় বড় গ্রুপ থেকে প্রস্তাব পেয়েছিলেন কোম্পানির মালিকানা বিক্রি করে দেয়ার। কিন্তু সেটি কখনোই করেননি আরমানি। তিনি সব সময়ই প্রতিষ্ঠানটির স্বাধীনতা বজায় রাখতে চেয়েছেন।

২০১৯ সালের প্যারিস ফ্যাশন সপ্তাহে জর্জিও আরমানি |ছবি: সংগৃহীত

ব্যবসা ও উত্তরাধিকার

পোশাক দিয়ে শুরু হওয়া আরমানি গ্রুপের এখন হোটেল, চকলেট ও ফার্নিচার, খেলাধুলা থেকে শুরু করে আরও কিছু ব্যবসা রয়েছে। আরমানি গ্রুপ আজ মাল্টি-বিলিয়ন ডলারের প্রতিষ্ঠান। এছাড়া অলিম্পিয়া মিলানো বাস্কেটবল ক্লাবের মালিকও ছিলেন আরমানি।

প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ তার পরিবারের হাতে ছেড়ে যান জর্জিও আরমানি। বোন রোসান্না, ভাইয়ের মেয়ে সিলভানা ও রোবের্তা, ভাগ্নে আন্দ্রেয়া কামেরানা এবং দীর্ঘদিনের সহচর লিও ডেল’অর্কোকে তিনি উত্তরাধিকারী হিসেবে করে গেছেন।

আত্মজীবনী ‘পার আমোর’-এ আরমানি লিখেছেন, ‘আমার পরে আরও আরমানি থাকবে। যারা আমার ভাবনা ধারণ করে এগিয়ে যাবে।’

আরও পড়ুন:

শুধু ডিজাইনার না, এক দৃষ্টিভঙ্গির নাম ছিল জর্জিও আরমানি। মানুষকে আত্মবিশ্বাসী, দৃপ্ত ও সংযত তৈরি পোশাক করেছে। ফ্যাশন মানে যে শুধু বাহ্যিকতা নয়, ব্যক্তিত্বের প্রকাশ- এটি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন আরমানি।

ফ্যাশন কিংবদন্তির প্রয়াণ

৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫; ইতালির এ প্রতিভাবান কিংবদন্তি ফ্যাশন ডিজাইনার ও আরমানি ব্রান্ডের প্রতিষ্ঠাতা জর্জিও আরমানি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। তার মৃত্যুতে শোক জানিয়ে জর্জিও আরমানিকে ইতালিয়ান ‘ফ্যাশনের গৌরব’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি।

এসএস