শরণার্থী শিবিরের এক বাসিন্দা বলেন, ‘জীবন অনেক কঠিন। রাস্তাগুলো বন্ধ। অ্যাম্বুলেন্স চলতে পারে না। বাসা কাছে হলেও যেতে পারি না। কারণ আর্মির হাতে স্নাইপার। কাছে গেলেই গুলি করবে।’
আটকা পড়া আরেক চিকিৎসক বলেন, ‘জেনিন হাসপাতাল এখন কারাগার। কিডনি রোগীরা চিকিৎসা শেষে ঘরে ফিরতে পারেন না। খাবার নেই, ওষুধ শেষ। ৩৬ ঘণ্টা কাজ করি, ঘুমাতে পারি না। ’
হাসপাতালে আটকা পড়ে নিজের ভয়ংকর পরিস্থিতি এভাবেই বর্ণনা করছিলেন অধিকৃত পশ্চিমতীরের জেনিন শরণার্থী শিবিরের এক বাসিন্দা আর ডাক্তার। গাজা থেকে চোখ সরানোর সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমতীরে হামলা জোরদার করেছে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা আর নিরাপত্তা বাহিনী। নিরাপদ নয় হাসপাতালগুলোও। হাসপাতালে যাওয়ার একমাত্র রাস্তা বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ইসরাইলের দাবি, ইরান সমর্থিত সশস্ত্র যোদ্ধাদের দমনেই এই সামরিক অভিযান, কিন্তু হামলায় প্রাণ যাচ্ছে সাধারণ মানুষের। এরপরও যাওয়ার জায়গা না থাকায় মৃত্যুভয়, আতঙ্ক নিয়ে এখনও এখানেই থাকছেন তারা। এই হামলায় চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৩০ জনেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে।
এক গাজা বাসিন্দা বলেন, ‘আমরা ঘর ছাড়তে চাইনি। আজ দেখলাম তারা ড্রোন পাঠালো, আমাদের চলে যেতে বললো। গাজার সঙ্গে যা হয়েছে, পশ্চিমতীরেও তাই হবে।’
আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘কোথায় যাবো জানি না। ক্যাম্পে ফিরতে চাই। স্বামী সন্তানকে ইসরাইলি সেনারা তুলে নিয়ে গেছে। তাদের জন্য অপেক্ষা করবো, প্রয়োজনে রাতে রাস্তায় ঘুমাবো।’
তবে অনেক ফিলিস্তিনি আবার জেনিন শরণার্থী শিবির আর আশপাশের এলাকা ছেড়ে দিচ্ছেন। কারণ, শত শত ইসরাইলি সেনা ড্রোন আর হেলিকপ্টার নিয়ে অবস্থান ঘাঁটি গেড়েছেন পশ্চিমতীরে। গেলো তিনদিন ধরে সেখানে চলছে আয়রন ওয়াল অপারেশন। হামলার পাশাপাশি পূর্ব জেরুজালেম, তুলকারেম, জেনিনে সমানে চলছে ধরপাকড়। গাজায় যুদ্ধবিরতির পর বেকার ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী জানিয়েছে, পশ্চিমতীরে আরও বাড়ানো হবে সেনা অভিযান। তাদের দাবি, ইরান সমর্থিত সশস্ত্র যোদ্ধাদের দমনেই এই উদ্যোগ।
এদিকে, হত্যাযজ্ঞ বন্ধ হলেও গাজায় বিরাজ করছে চরম মানবেতর পরিস্থিতি। যুদ্ধবিরতির পাঁচদিন পেরিয়ে গেলেও ধ্বংসপ্রায় উপত্যকায় টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে গাজাবাসী। গাজা শহরের বাসিন্দারা তাবু টানিয়ে চেষ্টা করছে বেঁচে থাকার। তবে আশার কথা, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া পরিবারের সদস্যরা এক হচ্ছেন।
এক বাসিন্দা বলেন, ‘এই তাবু চেয়েছিলাম। এখানে ১০ জন থাকতে পারবে। বাচ্চারা দক্ষিণাঞ্চল থেকে আসছে। বাচ্চাদের জন্য সব গুছিয়ে রাখছি।’
আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘জীবন অনেক কঠিন। এক বছর কষ্ট করেছি, কিন্তু তারা আমাদের কোন ব্যবস্থাই করছে না। দক্ষিণ থেকে আরও মানুষ আসলে কোথায় যাবে? ১৫ লাখ মানুষ আসছে। এতদিন ধ্বংসযজ্ঞ, বোমা হামলা আর দখলের ভয়ে ছিলাম। এখন বাস্তুচ্যুত আর তাবু টানিয়ে থাকার ভয়ে আছি। এই শীতে কি করবো? শহীদদের কি এটাই স্বপ্ন ছিল?’
মানবেতর পরিস্থিতি দক্ষিণাঞ্চলের খান ইউনিস শরণার্থী শিবিরেরও। যতোদূর চোখ যায়, শুধু তাবু আর তাবু। সংঘাতের কারণে রাফা পরিণত হয়েছে আরেক ধ্বংসস্তুপে। এখানে দৃষ্টিসীমার মধ্যে শুধু ভবনের ধ্বংসস্তুপ। রাফার বাসিন্দারা বলছেন, চ্যালেঞ্জ হলেও এই শহর পুনর্গঠনে নেমে পড়তে হবে সবাইকে।
এদিকে, গাজা উপত্যকায় ত্রাণ সরবরাহ শুরু হলেও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় সহজেই ট্রাক নিয়ে উপত্যকায় প্রবেশ সম্ভব হচ্ছে না। যদিও কাতার, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন স্থান থেকে গাজায় ত্রাণ প্রবেশ করছে। যুদ্ধবিরতির পর দৈনিক অন্তত ৬শ' ত্রাণবাহী ট্রাক গাজায় প্রবেশ করেছে।
যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, দ্বিতীয় ধাপে বন্দি বিনিময়ের আগে হামাস ৪ বন্দির নাম প্রকাশ করবে বলে জানিয়েছে সশস্ত্র গোষ্ঠীটি। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণের আগ মুহূর্তে গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও মধ্যপ্রাচ্য শান্ত হয়নি। ট্রাম্পের উদ্বেগ পুরো মধ্যপ্রাচ্য ঘিরে। যে কারণে গাজায় যুদ্ধবিরতি অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। তবে সংঘাত আর না বাড়াতে ইসরাইলকে ইরানের সামরিক স্থাপনায় হামলা চালানো থেকে বিরত থাকতেও বলেছেন তিনি।